Image-Description
Stories
সরস্বতী পুজো
Feb 9 2024 Posted by : montajpublishing

 একমুখো গলিটার দুধারে সারি দিয়ে টালির চালের বাড়িগুলো। ওখানেই থাকে শিখা, কাজল, দীপু, শ্যামল, ফুলি, শিবু, অজয় আর ওদের বেণু দিদি। এ গল্প ফুলির গল্প, ফুলিদের মতো আরো অনেকের গল্প। ওদের সকলের মায়েরাই কেউ পাঁচ,  কেউ তিন, কেউ বা চার বাড়িতে কাজ করে। বাবারা কেউ কারখানায় কাজ করে কেউ বা সব্জি নিয়ে বাজারে বসে আবার কেউ কেউ ট্রেনে হকারি করে। শিবুর বাবা আগে ট্রেনে হকার ছিল , ইউনিয়নের দাপটে কাজটা আর নেই। এখন স্টেশনের বাইরে  ফল বিক্রি করে। শ্যামলের বাবা সব্জি বিক্রি করে , কাজলের বাবা  টোটো চালায়। কিন্তু সে সব তো লক ডাউনের আগের কথা। তখন ওরা সবাই পাড়ার  মিউনিসিপ্যালিটির স্কুলে যেত, মিড ডে মিলে দুপুরের খাওয়াটাও পেত। সকলের মধ্যে ফুলিদের অবস্থাই  সবচেয়ে বেশি খারাপ।ওর বাপের যে সেই কতদিন আগে কারখানার মেশিনে ডান হাতের তিনটে আঙুল কাটা পড়েছিলো, ফুলির ভালো করে মনেও নেই। ফুলি খুব ছোটো ছিল বলে ফুলির মা তখন কোনো বাড়িতে কাজ নেয়নি। এখন অবশ্য চার বাড়ি কাজ করে সামাল দেয়, আবার অনেক রাত অবধি শাড়িতে ফল্স পাড়, জামায় বোতাম বসানোর কাজ করে। কারখানার চাকরিটা যেতে ফুলির বাপ একটা মেয়ে স্কুলের সামনে টিফিনে আর ছুটির সময়ে আলু কাবলি,ছোলা মাখা   বিক্রি করতো কিন্তু এখন তো সব স্কুলই বন্ধ। এদিক ওদিক ঘুরে সামান্য কিছু কোনোদিন বিক্রি হয়, কোনোদিন তাও নয়। ইস্কুল বন্ধ তাই ফুলিদেরও মিড ডে মিল বন্ধ।

    এখন ওরা সকলে শুধু খেলা করে। শিখা অবশ্য ওর মায়ের সাথে কাজে বের হয়, ওর মা আরো দুটো কাজ নিয়েছে কিনা। দীপু একটা চায়ের দোকানে আর অজয় একটা মুদির দোকানে ফাই ফরমাশ খাটে। বেনু দিদি অবশ্য, ওদের ছাড়বার পাত্রী নয়। বেনু দিদি একটা এন জি ও তে কাজ করে , নিজেও কী সব উঁচু ক্লাসের পড়াশোনা করে। সকালে সময় পায় না ঠিকই, কিন্তু সন্ধেতে ওদের সকলকে বই খাতা নিয়ে যেতেই হবে বেনু দিদির বাড়িতে।বেনু দিদির বাবা কোন ছোটবেলায় মারা গেছে, ওরা  তারপর থেকেই  এখানে থাকে। ওদের বাড়ির  ছাদটাই যা টিনের। বেনু দিদির মা ,ওরা মামণি ডাকে, গেলেই ওদের আগে মুড়িমাখা খেতে দেন,  আমতেল, পিয়াঁজ, চানাচুর, দিয়ে মেখে। যেদিন দিদির ফিরতে দেরি হয়, সেদিন ওদের গল্পও বলেন । টুনটুনির গল্প,বাবুই পাখির গল্প, এমনকি রবিঠাকুরের গল্পও। এইতো সেদিন যীশু ঠাকুরের জন্মদিনে  যীশুর গল্প  শোনালেন ওদের। ঐদিন বড়দিন ছিল বলে দিদি ওদের এক টুকরো করে কেক খাইয়েছিল। গত বছর শীতকালে ওদের নিয়ে পিকনিক করেছিলো বাড়িতেই, সকলের খুব আনন্দ হয়েছিল। এবারে অবশ্য পিকনিক হয়নি। ফুলি বয়সে ছোটো হলেও বোঝে এবারে ওদের কারো বাড়িতেই আর বাড়তি খরচ করতে পারবে না।

     আজকে বিকেলবেলাই দিদি ডেকেছে বলে ওরা সকলে দিদির ঘরে জমায়েত হয়েছে। দিদির মা সকলকে একটা করে বাড়িতে বানানো নতুন গুড়ের সন্দেশ দিয়েছে। আর বলেছেন,

"তোরা বোস চুপ করে। দিদির তোদের সাথে দরকারি কথা আছে।"

" কী কথা? কী কথা মামনি?" ওরা সকলেই একসাথে বলে ওঠে।

মামনি মুচকি হেসে যেতে যেতে বলেন,

"দিদি নিজেই এসে বলবে, বলেছে।"

পুরো আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে তবে দিদি এল।

"কী রে তোরা এসে গেছিস? বোস বোস। আমি আসছি।"

হাত পা ধুয়ে এসে দিদি ওদের কাছে বসল। কৌতুহলী মুখ গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,

"সবাই তো আমরা লেখাপড়া করি। তাহলে সরস্বতী পুজো করবি না? এসে গেলো তো সামনে।"

সবাই ভাবছিল,দিদি বোধহয় কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে বা পিকনিক করাবে। সরস্বতী পুজো তো ওদের স্কুলেই হয়। সেদিন স্কুলে সকলকে খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানো হয়। অবশ্য ইস্কুলে এ'বছর  পুজো হলেও বসিয়ে খাওয়ানো হবেনা শুনে ওদের সকলের খুব মন খারাপ হয়ে আছে। অবাক হয়ে সবাই তাকায় তাদের দিদির দিকে। বেনু বলে,

" দেখ, আর কটা দিন পরেই কিন্তু পুজো। এবার ছোটো করে হলেও আমরা কিন্তু পুজো করব।"

"ঠাকুরের তো অনেক দাম দিদি।" ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে শিখা।

 "আর কাজের বাড়িতে যদি ছুটি না দেয়।" ওদের একটা কাজের বাড়িতে বড় করে পুজো হয়, তাই ওর ভয়। বেনু দিদি ভরসা দেয়,

"আমি তোদের সবার বাড়িতে আর তোদের চায়ের দোকানে আর মুদিখানায়ও কথা বলে নেব।"

বেনুদিদির কথা এখানে সকলেই মানে,তাই ছেলে মেয়েগুলোই খুব খুশি হয়ে ওঠে।

 বেনু ছেলেমেয়েগুলোকে বোঝায় ―

"আসল ঠাকুর তো বই খাতা, তাই তো। আমরা বই পুজো করব বুঝলি।"

"এই দালান টা রঙীন শিকলি নিজের হাতে বানিয়ে আমরা সবাই মিলে সাজাবো আগের দিন বিকেলে।" 

"বই খাতা কখন আনতে হবে দিদি?" অজয় জিজ্ঞেস করে।

"মায়ের ঠাকুর ঘরের চৌকিতে আমি আলপনা এঁকে দেব।" বেনু বলে, তারপর শুকিয়ে গেলে সেখানে আমরা সবাই বই দিয়ে সাজাব। 

 ফুলি সবার থেকে ছোটো, ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। এবার সাহস করে এগিয়ে এসে বলে,

"দিদি, সরস্বতী ঠাকুর কে আমরা কি দিয়ে পুজো দেব?"

"চিঁড়ে,মুড়কি কদমা, সন্দেশ, ফল, আমাদের যেটুকু ক্ষমতা, আমরা তাই দিয়েই পুজো দেব।" বেনু বলে।

 "পুজো কে করবে, দিদি , আমাদের পুজোয় কি পুরুত আসবে?" জানতে চায় শিবু।

বেনু দিদি বলে ওঠে,

"ঠাকুরকে ভক্তি করে প্রণাম করে মনের কথা বলবি, তাতে আবার পুরুত লাগে নাকি। আমরা সবাই নিজের নিজের মনের কথা নিজেরাই ঠাকুর কে বলবো। আমি তোদের অঞ্জলীর মন্ত্র বলে দেবো।"

 ওদের মামনি বলে ওঠেন, 

"পুজোর দিন তোরা সবাই এখানে একসাথে খিচুড়ি, আলুভাজা আর চাটনি খাবি, বাড়িতে বলে রাখিস কিন্তু।" 

কাজল বলে ওঠে ―
 "বেশ মজা হবে ,বলো মামনি ,পুজো আর পিকনিক একসাথে।"

সবাই আনন্দে একসাথে হৈ হৈ করে ওঠে। ওদের সকলের মধ্যে অজয় একটু বড়ো। লকডাউনের আগে ক্লাস এইটে উঠেছিল। সে বলে ওঠে,

"দিদি, আমাদের মুদিখানার দোকান থেকেই তো সব কিনবে। আমি হরিকাকা কে বললে ঠিক একটু কমসম করে দেবে।"

কাজল বলে, "আমার মা যে বাড়িতে রান্না করে , তাদের তো মিষ্টির দোকান। মা বললে, ওরাও  নিশ্চয়ই কম দাম নেবে মিষ্টির।"

দীপু বলে ওঠে, "আমি চায়ের দোকানে দু'চার টাকা যা উপরি পাই, সবটা জমানো আছে। ঐ দিয়ে চিড়ে মুড়কি কদমা কিনব দিদি।"

শিবু ওর বাবার কাছ থেকে পাঁচ রকম ফল একটা করে নিয়ে আসবে বলে জানায়। জিজ্ঞেস করে,

"ওতে হবেনা দিদি?"

"খুব হবে। যে যা আনবি তাতেই হবে। তোদের দিদি ও তো আছে তোদের সঙ্গে।" বলে ওঠেন বেনুর মা। শ্যামল এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। এবার বলে,

"আমি বাবাকে বলবো  খিচুড়ির আলু আর ফুলকপি টা দিতে।"

ফুলি হঠাৎ বলে ওঠে,

"আর বেগুন শ্যামল দাদা, খিচুড়ির সাথে বেগুন ভাজা হবে না?"

সবাই ফুলির কথায় হেসে ওঠে।  বেনু দিদির মা এবার হেসে বলেন,

"নিশ্চয়ই,বেগুন ভাজা হবে আর  টমেটোর চাটনিও। ওটা আমার দায়িত্ব।"

ফুলি আবার বলে,

"মা যে বলে আমরা গরীব, তাহলে আমি কিছু দেবো না?"

মামনি ওকে আদর করে কাছে ডেকে বলেন,

"ফুলি তুমি রঙীন কাগজ এনো। নাহলে আমরা ঘর সাজাবো কী করে?"

ফুলি খুব খুশি হয়। বাচ্চাগুলো আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরে আসে।

 
               আজ সরস্বতী পুজো। মামনি কপি কড়াইশুটি দিয়ে খিচুড়ি ,আলুভাজা, বেগুন ভাজা আর টমেটোর চাটনি রান্না করেছেন। বেনু দিদির বাড়ির দালানটা সাজানো হয়েছে লাল নীল সবুজ হলুদ নানা  রঙের কাগজের শিকলি দিয়ে। দেওয়ালে টাঙানো হয়েছে বাচ্চাদের আঁকা ছবি, আসমানী রঙের আকাশ, ধূসর পাহাড়, কমলা সূর্য, নীল নদী , সবুজ গাছ, পাখির ঝাঁক, রঙীন ফুলের বাগান আর হ্যা ফুলি নিজের মন থেকে একটা অদ্ভুত ছবি এঁকেছে। একটা পাঁচিল ঘেরা বাগানে অনেক গুলো ফুল। প্রত্যেকটা ফুলে ওদের এক একজনের নাম লেখা আর বাগানের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা কালো রঙের রাক্ষস।   

ভোরবেলা সবাই চান করে কাচা কাপড় পরে এসে গেছে বেনু দিদির বাড়ি। সবাই মিলে গাছে থেকে ফুল তুলে এনেছে, মামনি পুজোর জায়গাটা সুন্দর করে সাজিয়েছেন। আল্পনা দেওয়া চৌকিতে একটা ছোট সাদা পাথরের সরস্বতী মূর্তি। দুপাশে সারি দিয়ে রাখা আছে সকলের বই খাতা, পাশে একটা কলমদানিতে কয়েকটা কলম রাখা।

চৌকির সামনে একটা পেতলের থালার ওপর  কলাপাতা পেতে সুন্দর করে  সাজানো হয়েছে চিড়ে মুড়কি, কদমা, গোটা ফল আর মিষ্টি। 

                দালানের দুটো ধার জুড়ে বেনুদিদি আলপনা এঁকেছে।তার মাঝখানে বসে দিদির সাথে সবাই মন্ত্র বলে গাঁদা ফুলের অঞ্জলী দিচ্ছে দেবীর পায়ে। অনেকটা দুর থেকেও শোনা যাচ্ছে ওদের মিলিত কিশোর কন্ঠের প্রণাম মন্ত্র,

 "সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে,
 বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।
 জয় জয় দেবী চরাচরসারে..."

-বিজয়লক্ষ্মী মুখার্জী 


Popular Books


Comments

  • Jolly Kanika

    মন ভালো হয়ে গেল এমন সুন্দর লেখা পড়ে।

    Feb 9 2024
  • Ranu Sil

    খুব সুন্দর লাগল।

    Feb 9 2024
  • Sudeshna Moitra

    ভালো লেখা।পড়ে খুব ভালো লাগল।

    Feb 9 2024
  • Sulagna Banerjee

    এক কথায় অপূর্ব.... মনটাই অন্যরকম হয়ে গেলো। ভালো থাকুন ????????????????

    Feb 18 2024
  • oxPCdWFMTmRXzjf

    BnyOeWaKVIHDvf

    Mar 14 2024
  • oxPCdWFMTmRXzjf

    BnyOeWaKVIHDvf

    Mar 14 2024
  • oxPCdWFMTmRXzjf

    BnyOeWaKVIHDvf

    Mar 14 2024

Write a Comment