রাজকুমারী সিসপিয়ার মন ভালো নেই। কী করে থাকবে বলো! রাজকুমারীর প্রিয় হরিণ মৃগচম্পা মানে চিম্পুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিকেলবেলা রাজবাড়ির বাগানে সখীদের সাথে সিসপিয়া খেলা করছিলেন, চিম্পুও ছোটাছুটি করছিল, তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছিল মনের আনন্দে। ক্লান্ত হলে রাজকুমারীর কোলের কাছে এসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, রাজকুমারী নিজের হাতে চিম্পুকে ডালিমের দানা খাইয়ে দিচ্ছিলেন। এ পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল, তারপরেই ঘটল অঘটন!
লুকোচুরি খেলার সময় সিসপিয়া লাল ফুলে ভরা একটা সুন্দর রঙ্গন গাছের ঝোপের পাশে লুকোলে চিম্পুও কুন্দফুল গাছের আড়ালে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল। রাজকুমারীর সখী বর্নিকা, সুস্মিতা, মন্ত্রীমশাইয়ের মেয়ে অলিভিয়া সকলেই বিভিন্ন গাছের আড়ালে লুকিয়েছিল। সেনাপতির মেয়ে কঙ্কনা সবাইকে খুঁজে বের করল কিন্তু চিম্পু কোথায়? সবাই খুঁজতে শুরু করলো চিম্পুকে, চিম্পু নেই, বাগানের কোত্থাও নেই। নেই তো বুঝলাম, কিন্তু গেল কোথায়? উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাগান, দ্বারে দু’জন প্রহরী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সবসময় তীক্ষ্ণ নজর রাখছে, তাদের এড়িয়ে একটা মাছিও প্রবেশ করতে পারবেনা। অলিভিয়া বলল, 'এ হতেই পারেনা চিম্পুর তো ডানা নেই যে উড়ে যাবে।'
তখুনি গর্ত থেকে মুখ বাড়িয়ে নেংটি ইঁদুর বলল, 'চিম্পু উড়তে পারেনা ঠিকই কিন্তু যে উড়তে পারে সে চিম্পুকে ধরে নিয়ে গেছে।' অমনি ছিড়িক ছিড়িক করে লেজ উঁচিয়ে পেয়ারাগাছের পাতার আড়াল থেকে কাঠবেড়ালি বলল, 'চিকি মিথ্যে কথা বলছে। তেমন কান্ড হলে আমি দেখতে পেতাম না! চিকি খুব রেগে গেল, 'কী? আমি মিথ্যে কথা বলছি? পেটুক কাঠবেড়ালি সারাদিন গপগপ করে খাচ্ছিস, তুই কী করে টের পাবি? প্যাঁচা আর প্যাঁচানি বটগাছের কোটরে বসে বসে ওদের ঝগড়া, রাজকুমারীর কান্না সব শুনছিল। প্যাঁচানি আর থাকতে পারল না, 'থাম, থাম তোরা, আর ঝগড়া করিসনে। আমি ডানার শব্দ শুনেছি, বেলা পড়ে আসছে বলে আবছা দেখতেও পেয়েছি। তোরা তো জানিস দিনের বেলা দেখতে পাইনে তাই এতক্ষণ চুপ করে ছিলাম। তোমরা একবার রাখালরাজাকে জিজ্ঞেস করে দেখো সে কিছু জানে কিনা!'
রাখালরাজা! সে আবার কে? সেনাপতির মেয়ে কঙ্কনা বলল 'আমি চিনি তাকে, ওর নাম আরফিন। বনের সব পশুপাখি ওকে ভালোবাসে, মাথায় রাংতার মুকুট পরে তীর ধনুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, রাত্রি হলে আম আঁটির ভেঁপু বাজায়।' কান্না থামিয়ে চোখের জল মুছে রাজকুমারী বলল, 'কেন রাত্তিরে ভেঁপু বাজায় কেন? ঘুমোয় না? কী করে ঘুমোবে! ওর যে মা নেই। আহারে! কী দুঃখ রাখালরাজার!
সত্যি খুব দুঃখ, ছোট্ট আরফিন মা, বাবার সঙ্গে হেসে খেলে দিন কাটাত, রাত্তিরে দুজনের কোলের মাঝে ঘুমোত। একদিন সকালে উঠে দেখে ওর মা, বাবা কেউ নেই। সেই থেকে ও রাত্রে ঘুমোয় না, ভেঁপু বাজায়, যদি ভেঁপুর শব্দ শুনে ওর বাবা, মা ফিরে আসে।
ওদিকে প্রহরী রাজদরবারে গিয়ে রাজামশায়কে খবর দিয়েছে। সেকি! সেকি! রাজকুমারী সিসপিয়ার চোখে জল! রাজামশায়, রাজমাতা দু’জনেই ছুটে এসেছেন উদ্যানে। তারপর সব শুনে পেয়াদাকে বললেন আরফিনকে ধরে আনতে। ধরে তো আনবে কিন্তু তাকে পাবে কোথায়? আরফিন কী রাজপ্রাসাদের পাশে ঘোরাঘুরি করছে? সে তো তখন অঞ্জনা নদীর পাড়ে বসে জলে পা ডুবিয়ে ভেঁপু বাজাচ্ছে। মাছেদের অনুরোধে গানও গাইছে, তবে সে গানের কথায় ঝরে পড়ছে ব্যথা। সে গান শুনে মাছের মায়ের চোখে জল টলটল করছে।
রাতের বেলা মায়ের বুকে ঘুমিয়েছিল খোকা
দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বাবাও ছিল পাশে
ওরা ছিল দারুন সুখে
জানো, ওরা ছিল দারুন সুখে
দৈত্য এসে আরফিনকে বানিয়ে দিয়ে বোকা
ছিনিয়ে নিয়ে মা-বাবাকে অট্টহাসি হাসে!
খোকা থাকে ভীষণ দুখে
শোনো, খোকা থাকে ভীষণ দুখে
খোকার বুকে ব্যথার ঢেউ
কোথায় গেল মা আর বাবা
বলতে পারো কেউ?
তোমরা বলতে পারো কেউ ?
খোকার বুকে ব্যথার ঢেউ।
রাজপেয়াদা ধরে আনলো আরফিনকে। আরফিন দেখেছে বৈকি! এরকম তো সে মাঝে মাঝেই দেখতে পায়। বলনি কেন? এতদিন কিছু বলনি কেন? বারে! কী করে বলবে? ও কী কোনদিন রাজদরবারে এসেছে? সিংদরজার প্রহরীরা ওকে ঢুকতে দিলে তবে তো বলবে! সভাসদগণ মাথা নেড়ে বলল, ঠিক কথা। আরফিনকে দোষ দেওয়া যায়না। কিন্তু এখন কী হবে? চিম্পুকে খুঁজে বের করার উপায় কী হবে? 'উপায় আছে রাজামশায়।'
'কে বলল, কে বলল কথাটা?'
'আমরা রাজামশায়, প্যাঁচা আর প্যাঁচানি। আমাদের কথা শুনুন আমরা রাখালরাজাকে পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এ নিশ্চয় কোনো শয়তান ঈগল পাখির কাজ সেই চিম্পুকে নিয়ে গেছে। না হলে আর কার ক্ষমতা হবে রাজবাড়ি থেকে চিম্পুকে নিয়ে যাবার! আরফিনের আর তর সয়না! এতদিন পরে মা বাবাকে খুঁজতে দূর-দেশে যেতে পারবে।
'আমিও যাবো রাখালরাজার সঙ্গে, অনুমতি দিন মহারাজ!'
সবাই তো হো হো করে হেসে উঠল, নেংটি ব’লে কি! ওকে দিয়ে কোন্ কর্ম উদ্ধার হবে? ও তো সবসময় ক্ষতি করে, লেপ তোষক কেটে দেয়, ধান গম খেয়ে রাজভান্ডার খালি করে। তারপর মাঝপথে প্যাঁচার খিদে পেলে ওকে কপ করে খেয়ে নেবে তখন! জিভ কেটে প্যাঁচা বলে 'ছি! ছি ! তাই কখনো হয়? আমাদের কী ধর্ম বলে কিছু নেই? মা লক্ষ্মীর বাহন আমরা!'
'ওকে অনুমতি দাও বাবা, চিম্পুর খবর ওই তো দিয়েছে!' রাজামশায় মেয়ের কথা ফেলতে পারলেন না। মহারানী একটা পুঁটুলিতে চিকি আর আরফিনের জন্য চিঁড়ে, গুড়, মুড়কি বেঁধে দিলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে যখন শেয়াল হুক্কা হুয়া করে ডেকে উঠল তখন প্যাঁচা প্যাঁচানি রাখালরাজা আর চিকিকে পিঠে চাপিয়ে রওনা হল। কত গ্রাম, শহর পেরিয়ে গেল কিন্তু ঈগলের দেখা মিলল না। দিনের বেলা প্যাঁচা, প্যাঁচানি গাছের কোটরে বসে বসে ঘুমোয়, রাত্রি হলে ওড়ে। তিন দিন তিন রাত কেটে যেতে চিকি বিজ্ঞের মত বলল, 'এভাবে হবেনা, ঈগলপাখিকে রাত্রে খুঁজে পাওয়া যায় নাকি? ও তো দিনের বেলা ঘোরে, এইসব হুতুম ভুতুম প্যাঁচার সঙ্গে আসাই ভুল হয়েছে! রাতের অন্ধকারে পাহাড়গুলো ভালো করে দেখাই গেল না, এভাবে কি খোঁজা যায়? ওদিকে রাজকুমারী সিসপিয়া হয়তো চিম্পুর শোকে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে! আমি আর তোমাদের সঙ্গে কোত্থাও যাবনা, আমাকে রাজবাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে এস।'
এ তো ভারি মুশকিল হল! নেংটি খুব ঝামেলা করছে, হুতুম ভুতুম দিনেরবেলা দেখতে পায়না সে কি ওদের দোষ?
রাখালরাজার ভালো লাগছিল না এই সব ঝগড়া। মা, বাবার খোঁজ তো পেলই না চিম্পুকে ও দেখতে পেল না। বেশ চিম্পুকে না পেল, একটা হরিণছানা ও কি দেশে নেই? ভালো লাগছেনা, কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। একা একা গাছ থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলো আরফিন। আরে! এই তো কত্ত হরিণ! সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠে ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে চিম্পু নেইতো? আরফিন চিম্পু বলে ডাকতে যাবে কে যেন কুটুস করে আরফিনের পায়ে কামড়ে দিল। নীচু হয়ে দেখে, চিকি। 'খুব সাবধান! লুকিয়ে পড়ো, লুকিয়ে পড়ো। ওই দেখো টুপি মাথায় একটা লোক, হরিণগুলোর পরে নজর রাখছে।'
ঠিক ঠিক। কে ওই লোকটা? ও কি দুষ্টু লোক? সব হরিণদের চুরি করে এনেছে? এমন নানা প্রশ্ন আরফিনের মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। চিকি আর আরফিন একটা ঝুপসি গাছের আড়াল থেকে দেখতে লাগল, ওই লোকটা আর হরিণগুলোকে নিয়ে কেউ যেন পুতুল খেলছিল। কোন এক অদৃশ্য জাদুকরের হাতের পুতুল এরা, সুতোর টানে চলছে ফিরছে। তারপর বেলা ডুবলে সুতো গুটিয়ে ওদের টেনে তুললো পাহাড়চূড়োয়। পাহাড়ই তো! এতক্ষণ ওদের নজরই পড়েনি, পাহাড়ের মাথায় পেল্লায় রাজপ্রাসাদ। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসতেই প্রাসাদের মাথায় আলো জ্বললো, চিকি আর আরফিন হুতুম ভুতুমের পিঠে চেপে চলল পাহাড়ের মাথায়। কেমন যেন পাহাড়টা, একদম ন্যাড়া, বড় গাছ তো দূরের কথা একটা ছোট গাছও নেই। কেউ তাড়া করলে কোথায় লুকোবে ওরা? কী অন্ধকার! সকাল না হলে ওরা কিছু দেখতেও পাবেনা আবার সকাল হলে হুতুম ভুতুম কানা। খুব মুশকিল! এমন সময় চিকি বলল, 'পেয়েছি, পেয়েছি এস আমার পিছন পিছন এস, খুব সাবধান! শব্দ কোরোনা।' হুতুম ভুতুম, চিকি, আরফিন যেইনা সুড়ঙ্গে ঢুকতে যাবে কে যেন এক ঝটকায় ওদের টেনে আনল, তারপর ফিসফিস করে বলল, 'মরবার শখ হয়েছে? ওই সুড়ঙ্গ সোজা চলে গেছে রাক্ষসীর খাসমহলে।' সর্বনাশ! এটা তাহলে রাক্ষসীর প্রাসাদ?
'কে গো তুমি আমাদের বাঁচালে?
'আমার কথা পরে হবে, এখন তোমরা বলো এখানে কেন এসেছ? একবার যদি রাক্ষসী তোমাদের খোঁজ পায় তাহলে দাস বানিয়ে রেখে দেবে। যেমন আমাকে আর আমার বৌকে রেখেছে। সারাজীবনে আর কোনদিন নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে ফিরতে পারবেনা।...চুপ চুপ ওই শোনো রাক্ষসী জোরে জোরে নাক টানছে, তোমাদের গায়ের গন্ধ পেয়েছে মনে হয়। এবার কী হবে? তোমাদের বোধ হয় বাঁচাতে পারলাম না। লুকিয়ে পড়ো, লুকিয়ে পড়ো।' ওদের টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে একটা বড় কৌটোর মধ্যে ঢুকিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে দিল। ওরা কিছুই বুঝতে পারল না কে ওদের বাঁচাল! তবে বুঝল রাক্ষসীর বাড়িতে ভালো লোক আছে, তাই সাহস করে ঢাকনা একটুকুনি ফাঁক করে চিকি লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। হুতুম ভুতুম খুব রেগে গেল, 'একেবারে আহাম্মক, কারো পায়ের তলায় পড়লে চিকি একেবারে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। আমরা ফিরে গিয়ে রাজকুমারী সিসপিয়াকে কি বলব, ওকে সঙ্গে আনাই ভুল হয়েছে!' রাখালরাজা আর কী বলবে, এমনিতেই ও চুপচাপ, একা একা বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। সবাই জোর করে চিম্পুকে খুঁজতে ওকে পাঠিয়ে দিল, কিন্তু এখন কী করবে? কৌটো থেকে বেরিয়ে কী একবার দেখবে চিম্পু ওই হরিণদের মধ্যে আছে কিনা! থাকলে রাক্ষসী যখন ঘুমোবে তখন চিম্পুকে নিয়ে হুতুম ভুতুমের পিঠে চেপে পালিয়ে যাবে! কিন্তু বাবা- মাকে পাবে কোথায়? তাদের কী কোনদিনই পাবেনা? ভাবতে ভাবতে তার মনে হল, আচ্ছা এই রাক্ষসী ওদের খেয়ে ফেলেনি তো! জানতে পারলে তীর ধনুক দিয়ে রাক্ষসীকে মেরে ফেলবে! আরফিন এসব ভেবে কৌটো থেকে যেই নামতে যাবে তখুনি চিকি এসে ওকে থামাল! 'শোনো সব খবর নিয়ে এসেছি!'
'কী করে পেলে খবর?'
চিকি কান নাড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বলল, 'এ আর এমন কী ব্যাপার সোজা চলে গেলাম মৃগশালে! আমাকে দেখেই চিম্পু এগিয়ে এল, 'চিকি দাদা খুব সাবধান! রাক্ষসী জানতে পারলে কপাৎ করে গিলে খাবে, এই রাজপ্রাসাদের রাজা, রানী সবাইকে খেয়েছে, হাতি, ঘোড়া সব। আসার সময় কত পাথর পড়ে আছে দেখেছ? ওগুলো কিন্তু পাথর নয় এই সারান্ডা রাজ্যের প্রজা।'
'তাহলে এতগুলো হরিণ পুষে রেখেছে ওদের খায়না কেন?'
'আসলে ওদের খাবার জন্য পোষেনি, রাক্ষসী হরিণ পুষেছে কস্তুরীর লোভে। যৌবন ধরে রাখার জন্য, কিন্তু রাক্ষসী এত হরিণ পুষলেও এখনো কস্তুরী পায়নি। তাই যেখানে হরিণ দেখে ওর পোষা ঈগলপাখি গিয়ে ধরে আনে।'
'কী সাংঘাতিক কথা!'
'এখনই সাংঘাতিকের কী হল? সব কথা বলাই হয়নি, হরিণগুলো চরানোর জন্যে একটা লোক রেখেছে। সেই লোকটা যখন সবুজ মাঠে হরিণ চরায় রাক্ষসী খুব শক্ত দড়ি বেঁধে দেয় লোকটার পায়ে।'
'দড়ি? কই দেখলাম না তো! দেখবে কী করে? সে দড়ি এত সূক্ষ্ম যে দেখা যায় না। এভাবে হরিণগুলোর পায়েও দড়ি বাঁধা থাকে। আরো একজন আছে এই মৃত্যুপুরীতে। সে হল হরিণ পালকের বউ, শয়তানকে রান্না করে খেতে দেয়, ওদের ধরে এনেছে শয়তান ঈগলপাখি আর...' — বলতে বলতে থেমে গেল চিকি। কার যেন পায়ের আওয়াজ হচ্ছে, তাহলে রাক্ষসী কি ওদের গায়ের গন্ধ পেয়ে চলে এসেছে? ওদের খেয়ে ফেলবে, নাকি পাথর বানিয়ে দেবে? আরফিন তীর ধনুক নিয়ে তৈরী, একবার চেষ্টা করে দেখবে রাক্ষসীকে জব্দ করা যাবে কি না! না, না,রাক্ষসী নয়, অন্য কেউ। ফিসফিস করে বলল, 'একদম কৌটো থেকে বেরোবে না, এই নাও খাবার, পদ্মকুঁড়ির পায়েস।' আরফিন কোনোদিন এমন পায়েস খায়নি, আর খাবেই বা কী করে? সেই কোন ছোটবেলায় মা হারিয়ে গেছে, বেশিরভাগ দিনই গাছের ফল, ঝরনার জল খেয়ে থাকে, কোনো কোনদিন কেউ ডেকে ভাত খেতে দেয়। কিন্তু পদ্মকুঁড়ির পায়েস কক্ষনো খায়নি। 'আচ্ছা হুতুম ভুতুম কী খাবে? ওরা কি পায়েস খায় নাকি! ওদের পেটেও তো ছুঁচোয় ডন মারছে।' একথা শুনেই সে কতগুলো আরশোলা ধরে দিল, যাবার সময় বলে গেল, 'খবরদার বাইরে বেরোবে না। সকাল না হওয়া পর্যন্ত চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকো।' ঘুম? সে বলে কী! রাক্ষসীর নাকের ডগায় বসে কেউ ঘুমোতে পারে? তাহলে কী করবে আরফিন, ফিসফিস করে শলা পরামর্শ করবে? না, বাবা দরকার নেই, তাতে বিপদ আরো বাড়বে। তার থেকে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বসে বসে ভাবা ভালো, কাল সকালে দিনের আলোয় এই প্রাসাদ ভালো করে ঘুরে দেখতে হবে, রাক্ষসী রানীর প্রাণভোমরা কোথায় আছে খুঁজে বের করতে হবে। তারপর দেখবে হুতুম ভুতুমের ঠোঁটের ধার, ভোমরাকে ধরে টুপ করে মুখে ফেলে চিবিয়ে খাবে। চিকি হরিণগুলোর পায়ের দড়ি কেটে দেবে, তাহলে ওরা পালিয়ে যাবে। আরফিন আম আঁটির ভেঁপু বাজিয়ে ওদের নিয়ে যাবে সিসপিয়ার কাছে। খুব খুশি হবে রাজকুমারী, রাজা রানী খুব খুশি হবেন।
আচ্ছা হরিণপালক, তার বউ ওদের কী হবে? রাক্ষসী মারা গেলে আর ভয় কিসের? ওরা ওদের বাড়ি চলে যাবে। বেশ, বেশ তা না হয় হল, যেসব প্রজা পাথর হয়ে আছে তাদের কি মুক্তি হবেনা? হবে বৈকি! আরফিন পদ্মসরোবরের জল পদ্মপাতায় করে এনে সারান্ডার পাথরের উপর ছড়িয়ে দিলেই সবাই বেঁচে উঠবে। প্রজারাই গোপন কুঠুরীর দরজা ভেঙ্গে রাজা, রানীকে উদ্ধার করে সিংহাসনে বসাবে। আবার রাজপ্রাসাদ আলোয় ঝলমল করবে, ভারি মজার ব্যাপার হবে সেসব। কিন্তু রাখালরাজার মা, বাবা তাদের কে খুঁজে দেবে? একটা টিকটিকি টিক টিক করে ডেকে উঠতে আরফিন চোখ খুলে দেখে কৌটোর ঢাকনার ফাঁক দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে, তার মানে স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষণ। হুতুম ভুতুম চোখ বুজে বসে আছে চুপ করে, কিন্তু চিকি গেল কোথায়? না, এভাবে বসে থাকলে কিছুই হবেনা। যে করেই হোক রাজকুমারী সিসপিয়ার আদরের চিম্পুকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আম আঁটির ভেঁপু কোমরে গুঁজে মাথার রাংতার মুকুটটাকে ঠিক করে হাতে তীর ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আরফিন। একের পর এক ঘর পার হয়ে যাচ্ছে, জন-মনিষ্যি নেই। সাজানো খাটবিছানা, দেরাজ আলমারি আয়না কিন্তু একটাও লোক নেই, কেমন যেন থম থম নিঃঝুম, শুধু একটা ঝড়ের মত শব্দ শোনা যাচ্ছে। অথচ আকাশ পরিষ্কার, ঝক ঝক করছে রোদ্দুর। তাহলে এই শব্দটা কিসের? আর একটু হলেই উড়ে জানলা গলে নীচে পড়ে যাচ্ছিল আরফিন, বাপরে এটা নাকের গর্জন! নিঃশ্বাসের হাওয়া এমন হয়? হবে না কেন শুনি? এ তো আর মানুষের নিঃশ্বাস নয়, এ হল রাক্ষসীর নাক! সে রাক্ষসী কোথায়? একটা থুত্থুরি বুড়ি মুলোর মত দাঁত বের করে বিশাল একটা পালঙ্কে ঘুমোচ্ছে, ওরে বাবা বুড়ি রোগা হলে কী হয়! খ্যাংরাকাঠি হাত পায়ের নখগুলো কী লম্বা, কী ছুঁচালো। ওরে বাবা! ওই নখ পেটে ঢুকিয়ে দিলে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসবে, আরে আরে চিকি এখানে কী করছে? বুড়ির শনের নুড়ি চুলগুলো কুচ কুচ করে কাটছে কেন? চিকিটা আসলে মহাপাজী, ওর ধারালো দাঁত দিয়ে কিছু না কাটতে পারলে দাঁত শিরশির করে। এই বিদঘুটে বুড়িকে দেখে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, যাই রাক্ষসীর খোঁজ করি।
আরফিন কিনা সাদাসিধে ছেলে তাই সে বুঝতেই পারল না ওই বুড়িটাই রাক্ষসী। চিকি জানে বলেই বসে বসে চুল কাটছিল, রাক্ষসীর চুলের সঙ্গেই হরিণ, হরিণপালক বাঁধা আছে, তাই চুল কাটলেই ওদের মুক্তি। রাক্ষসীর চুল খুব পোক্ত, ওই চুলের দড়ি কাটা সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। চিকি ছোট্ট এইটুকুনি হলে কি হবে, ওর দাঁতের ধার মারাত্মক! একটা চিন্তার বিষয় আছে ঈগল পাখি দেখতে পেলেই সর্বনাশ! তবে চিকিকে ধরা অত সহজ নয়, চোখের পলকে কোথায় যে লুকিয়ে পড়বে ঈগল খুঁজেই পাবেনা। ওর মস্ত ডানা নিয়ে কোনো ফাঁক ফোকরে ঢোকা ওর কম্ম নয়। ওরে বাবা! বুড়ি জেগে উঠবে নাকি? এত নড়াচড়া করছে কেন? রাঁধুনীকাকি যে বলল রাক্ষসী সেই গোধুলিবেলায় সুয্যি যখন পদ্মসায়রের জলে স্নান করতে নামে তখন জেগে ওঠে। শয়তান ঈগল সব জন্তু জানোয়ার ধরে আনে সেই সব খায়, তবে হরিণগুলো খায়না। রাক্ষসী সেগুলোকে পোষে, যেই না কস্তুরীর গন্ধ বেরোবে সেই হরিণগুলোর নাভি কাটবে, মাংস খাবে। খাওয়াদাওয়া সেরে রাক্ষসী রূপচর্চা করতে বসে,পদ্মফুলের পাপড়ি বেটে মুখে মাখে, জবাফুলের তেল চুলে লাগায় কিন্তু যাই করুক না কেন গায়ের দুর্গন্ধ যায়না। তাই পদ্মকুঁড়ির পায়েস খায়, তবুও গন্ধ যায়না। চিকি কুচ কুচ করে চুল কাটতে কাটতে ভাবল, রাখালরাজা বড্ড বোকা, রাক্ষসীকে চিনতেই পারল না, অবশ্য চিনতে পারলেই বা কী হত! তীর ধনুক দিয়ে মারতে তো পারত না। রাক্ষসীর প্রাণভোমরা খুঁজে না পেলে মহা মুশকিল, ওদিকে হুতুম ভুতুম দিনেরবেলা কিছুই করতে পারবেনা। না, না, এসব ভেবে সময় নষ্ট করলে হবেনা, তাড়াতাড়ি দাঁত চালাই।
ওদিকে আরফিন চুপি চুপি পুরো প্রাসাদ ঘুরে দেখতে দেখতে চলে এসেছে রান্নাঘরে। বাব্বা কী বিরাট কড়াই, টগবগ করে কী যেন ফুটছে, টকটকে লাল। খুব ভয় পেয়েছে আরফিন, ওগুলো রক্ত নাকি? না,না, রক্ত নয় জবাফুলের তেল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মানুষের গলায় কে যেন বলল, কিন্তু বাছা এত্তুটুকুনি ছেলে তুমি কেমন করে এখানে এলে? পালাও, পালাও রাক্ষসী জানতে পারলে আর রক্ষে নেই জ্যান্ত চিবিয়ে খাবে। ‘মা’.... ছুট্টে গিয়ে আরফিন জড়িয়ে ধরেছে একগলা ঘোমটা দেওয়া রাঁধুনিকে | ‘অরু আমার অরু তুই এখানে কি করে এলি বাপ! আমি কী করে তোকে বাঁচাব? তোর বাবা ওই পাহাড়ের নীচে গেছে হরিণ চরাতে।'
'বাবা! বাবাও এখানে আছে, চলো মা আমরা সবাই মিলে রাক্ষসীকে মারি।'
'ওরে রাক্ষসীকে মারতে হলে প্রাণ ভোমরাকে মারতে হবে তবেই রাক্ষসী মরবে।'
'কোথায় আছে প্রাণ ভোমরা, আমি এক্ষুনি তাকে মারব।
'প্রাণভোমরা আছে পদ্মসায়রের জলে মস্ত বড় কাতলা মাছের পেটে। সে মাছ জালে ধরা পড়েনা, বড়শিতে গাঁথেনা, একটাই মাত্র রাস্তা আছে মাছটাকে উপরে তোলার, মাছটা যখন ভুঁস করে জলের থেকে মাথা তুলবে তখন যদি কেউ তীরের ফলায় গেঁথে তাকে উপরে তুলতে পারে। তবেই মরবে রাক্ষসী। কিন্তু খুব সাবধান! দু’বার সুযোগ পাওয়া যাবে না, একবারেই কাজ সম্পন্ন করতে হবে, আর সেই কাজ করতে হবে সুয্যি ডোবার আগে।'
এ কি সায়র না সমুদ্দুর? কিন্তু এমনভাবে পদ্মফুলে ঢেকে আছে সায়র জলতো দেখা যাচ্ছে না, জল দেখতে না পেলে মাছটাকে দেখবে কী করে?
'চুপ চুপ অরু পায়ের শব্দ যেন না হয়, তাহলে মাছটা উপরে উঠবে না। পুরো সায়র ঘুরে এস পালক পায়ে, কোনোভাবে ব্যথা পেলেও শব্দ নয়, সূর্য মাথার ওপরে, এরপরে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করবে তার আগেই যা করার করতে হবে।'
আরফিন ঘুরছে সায়রের পাড় ধরে, নেই কোথাও একটু খালি জায়গা নেই, পুরো জল পদ্মফুলে ঢাকা। তাহলে কী হবে! মাছ কি উঠবেনা ভুঁস করে? হঠাৎ আরফিনের নজরে পড়ল সায়রের ঠিক মধ্যিখানে মুক্তোর মত টলটল করছে জল। আরফিন চলা থামিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল, টান টান ধনুকের ছিলা। এক পল, দুই পল কত পল, মিনিট ঘন্টা চলে গেল, জল স্থির একটা বুড়বুড়িও উঠল না। সূর্য ঢলতে ঢলতে পশ্চিমের কিনারে পৌঁছে গেল প্রায়, তবে কি মাছ নেই? তাহলে কোথায় আছে রাক্ষসীর প্রাণভোমরা? তবুও সূর্য অস্ত না যাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে একচুলও নড়বে না আরফিন। ঠিক তখুনি.. ভুঁ—স...আর তক্ষুনি সাঁ করে তীর বিঁধে গেল কাতলা মাছের চোখে। এক মুহূর্তও দেরী নয়, এক আছাড় মারল আরফিন, স্থির হয়ে গেল কাতলা, রাক্ষসীর প্রাণভোমরা।
ওদিকে হাঁউ মাঁউ খাঁউ করতে করতে রাক্ষসীও স্থির হয়ে গেল। মাথার উপরে চক্কর কাটছিল শয়তান ঈগলটা। তীর ছুঁড়ে ওকেও মেরে মাটিতে নামিয়ে আনল আরফিন। সূর্য তখন পদ্মসায়রের জল ছোঁব ছোঁব, পদ্মপাতায় করে জল নিয়ে রাখালরাজা ছিটিয়ে দিল সব পাথরে। হইহই করে জেগে উঠল প্রজারা, হাতি, ঘোড়া সব। তারাই গোপন কুঠুরীর দরজা ভেঙ্গে বের করে নিয়ে আসলো রাজা রানীকে। ঝলমল করে উঠল রাজপ্রাসাদ।
রাজামশায় বললেন, 'আরফিন তুমি আমার দেশে থেকে যাও।' আমি সন্তানহীন, দত্তক নেব তোমায়। তুমি হবে সারান্ডার রাজকুমার। রাখালরাজা আরফিন বলল, 'আমি যা চাই তা পেয়ে গিয়েছি। আমার মা, বাবা আর রাজকুমারীর চিম্পুকে খুঁজে পেয়েছি।'
তারপর হুতুম ভুতুমের পিঠে চেপে মা, বাবা, চিম্পু, চিকিকে নিয়ে রাখালরাজা আরফিন আম আঁটির ভেঁপু বাজাতে বাজাতে ফিরে এল নিজের দেশ মুরান্ডায়। ভেঁপুর শব্দ শুনে বেরিয়ে এসে রাজকুমারী সিসপিয়া চিম্পুকে কোলে নিয়ে চোখের জল মুছে হেসে উঠলেন খিলখিল করে| রাখালরাজা, চিকি, হুতুম ভুতুম সবাইকে ঘিরে নেচে নেচে গান গাইতে লাগল সখীরা –
রাখালরাজা, রাখালরাজা মস্ত বড় বীর
রাক্ষসীর প্রাণ কেড়েছে, হেনে ধনুক তীর
নেংটি চিকি, প্যাঁচা প্যাঁচানি চিম্পু নিয়ে ঘরে
সেই খুশিতে, মালা পরিয়ে নেব বরণ করে
আমরা নেব বরণ করে --
লেখিকা : সবিতা বিশ্বাস