মুখ ভার করে গালে হাত দিয়ে বারান্দায় বসে ছিল মিষ্টি। পাশের বাড়ির ঝন্টুদের হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। আর মাত্র একদিন বাদেই দোল। আজ ন্যাড়াপোড়া। তারই প্রস্তুতি চলছে ঝন্টুদের বাড়ি।
শুধু মিষ্টির অনুমতি নেই ওই আনন্দে যোগ দেওয়ার।
ধুস! ভালো লাগে না। ধুপধুপ পা ফেলে পড়ার ঘরে ঢুকল মিষ্টি। গত বছরও কত মজা করেছে। ঝন্টুদের বাড়ির ন্যাড়াপোড়ায় মায়ের সঙ্গে গিয়ে পুজো করেছে, আগুনের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নেচেছে।
" হোলি হ্যায়" ... চিৎকারে গলা ফাটিয়েছে। সবাই মিলে হাততালি দিয়ে গান গেয়েছে,
"আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া,
কাল আমাদের দোল,
পুন্নিমাতে চাঁদ উঠেছে,
বলো হরিবোল।"
হরির লুটের বাতাসা কুড়িয়েছে। আর এ'বছর?
প্রতিবার, দোলের দিন সকাল হতেই মা পরিয়ে দিতেন একটা পুরোনো, রং-চটা ফ্রক, সারা গায়ে সর্ষের তেল মেখে মিষ্টি ছুটত ঝন্টুদের বাড়ি। ওদের আবার একান্নবর্তী পরিবার কিনা। গোটা দশ বারো নানা সাইজের ছেলেমেয়ে। বিনি, চুনি, ঘন্টা, চরকি আরও কত নাম। পাড়ার আরও ছেলে মেয়েরাও যোগ দিত দোল খেলায়।
সেই নার্সারি থেকে মিষ্টি দোল খেলতে যেত ওদের বাড়ি। ওদের সঙ্গে মাতত উৎসবের হুল্লোড়ে। রং মেখে ভূত হত বন্ধুদের সঙ্গে।
আবার সবাই মিলে এ'বাড়িতে ছুটে আসত মা, বাবা, ঠাম্মা, দাদুনকে রং মাখাতে।
এমনকি দাদুন আর ঠাম্মা অবধি দোল খেলতেন মিষ্টিদের সঙ্গে।
দাদুনের কথা মনে পড়তেই চোখ জলে ভরল। প্রতিবার, দাদুন ব্যাগ ভরে নানা রকমের আবিরের প্যাকেট কিনে আনতেন। সঙ্গে একটা বিশাল পিচকারি। উঠোনের প্লাস্টিকের বালতিতে নীল রং গোলা হত। তাই পিচকারিতে ভরে সবার গায়ে রং ছিটিয়ে দেওয়া। হাসি পেল মিষ্টির।
নীল রঙের বাঁদর লাগত সবাইকে। এরপর, এক মুঠো আবির নিয়ে পা টিপে টিপে দাদুনের পিছনে গিয়ে দাঁড়াত।
দাদুন তখন হয়তো বাজার থেকে আনা মাছ, সবজির হিসেব দিতে ব্যস্ত ঠাম্মাকে।
গলা জড়িয়ে ধরে দাদুনের মুখে, মাথায় আবির মাখিয়ে দিত। দাদুন ও সব ফেলে, "তবে রে গুন্ডি..." বলে কোলে তুলে নিতেন। মিষ্টির মুখে মাখিয়ে দিতেন গোলাপি আবির।
দাদুনের টাকের লাল আবির চিকচিক করত সূর্যের আলোয়।
ঠাম্মা বাড়িতে তৈরী করতেন রসে টুসটুস মালপোয়া আর দুধপুলি। আলাদা বাটিতে তুলে রাখতেন মিষ্টির জন্য।
উলুস! জিভে জল এসে গেল।
কিন্তু এবার? দোল খেলার মুড নেই কারো। দাদুনের নাকি কী ভীষণ একটা অসুখ করেছে। মাসখানেক আগে মর্নিংওয়াক থেকে ফিরে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন দাদুন।
মিষ্টি ও দুধ, বিস্কুট খাচ্ছিল স্কুলে যাওয়ার আগে। হঠাৎ দাদুন হাতে নিজের বুক চেপে ধরলেন। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মুখ দিয়ে কেমন ফেনা ফেনা বেরোচ্ছিল। মিষ্টি তো দারুণ ভয় পেয়েছিল।
চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে সবাই ছুটে এল। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে দাদুনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। মিষ্টির বুকের ভেতরটা কেমন ধকধক করছিল। শুধু মনে হচ্ছিল,আর দাদুনকে দেখতে পাবে না।
যাই হোক দু'দিন পর দাদুন ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরলেও, মিষ্টি দেখেছে অনেক ওষুধ খেতে হবে ওনাকে।
বাবা ঠাম্মা আর মাকে সব বুঝিয়ে দিল। মনখারাপ নিয়ে মিষ্টি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিল।
বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"মিষ্টি তো এখন ক্লাস থ্রীতে পড়ে। অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। একদম যেন দাদুনকে ডিসটার্ব না করে। লক্ষী মেয়ে হয়ে থাকে।"
তাই তো ছিল। মনে মনে ভেবেছিল, লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকলে দোল আসার আগেই দাদুন একদম ফিট এন্ড ফাইন হয়ে যাবে।
কিন্তু তা হল কই?
বরং দিন দশেক আগে দাদুন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তবে থেকে দাদুন হাসপাতালে। বাবা আর ঠাম্মা রাতদিন দাদুনের কাছে। বাড়িতে মা-ও বিষন্ন মুখে ঘুরছেন।
গুটি গুটি পায়ে মায়ের কাছে যায় মিষ্টি। মা কোলে টেনে নেন।
ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে মিষ্টি,
"এবছর আমরা একটুও দোল খেলব না?"
মা মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খান।
"তুমি তো সব বোঝো মামণি। দাদুনের এমন শরীর খারাপ। তোমার কি মন লাগবে দোল খেলায় ওনাকে ছাড়া?"
"ঠিক ঠিক।" মাথা নাড়ে মিষ্টি।
"এসো, আমরা দুজনে মিলে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি, শিগগির দাদুনকে ভালো করে দাও।"
চোখ বন্ধ করে তাই করে মিষ্টি।
"হে ঠাকুর, দোলের আগে দাদুনকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে দাও,প্লিজ।"
কী ভেবে আর একটু যোগ করে। "আমি তোমায় ক্যাডবেরি চকোলেট খেতে দেব।"
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ঝন্টুদের বাড়ি ন্যাড়াপোড়া শুরু হয়ে গেছে। আওয়াজ ভেসে আসছে। পাঁচিলের ওপর দিয়ে আগুনের শিখা দেখা যায়।
ঝন্টু আর বিনি অবশ্য ওকে ডাকতে এসেছিল।
"চল, ন্যাড়াপোড়া দেখবি।"
মিষ্টি নিজেই মানা করেছে। আজ ও শুধু ভগবানের কাছে দাদুনকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করবে।
লক্ষ্মী মেয়ের মত খেয়ে ঘুমোতে গেল মিষ্টি। নাহ! আর মন খারাপ করবে না। ও জানে ভগবান ওর প্রার্থনা শুনবেন। ঠিক ভালো করে দেবেন দাদুনকে।
এ'বছর নাই বা দোল খেলল, আগামী বার চুটিয়ে খেলবে, খুব খুব এনজয় করবে।
ঠাম্মির ডাকে ঘুম ভাঙল মিষ্টির।
"ওঠ সোনা, দোল খেলবে না?"
তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল মিষ্টি।
বাইরে কার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে? কে ডাকছে দিদিভাই বলে? একলাফে বাইরে আসতেই ছানাবড়া চোখ!
ড্রয়িংরুমে একটা হুইল চেয়ারে দাদুন বসে আছেন!
পাশে দাঁড়িয়ে মা, বাবা! দুজনই হাসি মুখে ধরে আছেন দাদুনকে।
হাত বাড়ালেন দাদুন।
"এসো দিদিভাই। এই দেখ, কত রং এনেছি তোমার জন্য। আর এই সবুজ পিচকারীটা। পছন্দ হয়েছে?"
চেষ্টা করেও চোখের জল আটকাতে পারল না মিষ্টি।
ভগবান ওর কথা শুনেছেন!
"তুমি ভালো হয়ে গেছ দাদুন?"
"ভালো যে হতেই হত,আমার মিষ্টি দিদিভাইয়ের জন্য। আজ দোল আর আমি হাসপাতালে পড়ে থাকব, সে কখনও হয়? তাই চলে এলাম।"
ঠাম্মা বললেন, "আমি যাই...মালপোয়া বানাতে হবে।"
মা বললেন, "মিষ্টি তুমি ফ্রেশ হয়ে একটা পুরনো ফ্রক পরে নাও।"
বাবা বললেন, "আমি ঝন্টুর বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি। মিষ্টি দোল খেলতে ওদের বাড়ি যাচ্ছে।"
মিষ্টি এগিয়ে এসে রঙের প্যাকেট থেকে লাল আবির বের করে দাদুনকে মাখিয়ে দিল।
জানলা দিয়ে সকালের সোনা রং রোদ্দুর এসে লুটোপুটি খাচ্ছে ড্রয়িংরুমের মেঝেতে।
সেই আগের মত আবির চিকচিক করছে দাদুনের টাক মাথায়। লাল রং লেগেছে সারা মুখে।
মিষ্টি হেসে ফেলল।
"দাদুন, তোমায় না ঠিক... হনুমানের মত দেখাচ্ছে।"
অনাবিল খুশির হাসিতে ভরে উঠল ড্রয়িংরুমের প্রতিটি কোনা। এক ভীষণ ভালো লাগার বাতাসে টিং টং বেজে উঠল জানলায় ঝোলানো উইন্ডচাইমটা। বাজতেই থাকল...
টিং লিং টিং লিং টিং...
-শ্রাবণী গুহ