ইন্টার স্কুল ডিবেট কম্পিটিশন
অর্গানাইজড বাই অল বেঙ্গল স্টেট এডুকেশন ট্রাস্ট
সাদা অক্ষরে লেখা নীল ফেস্টুনটা টাঙানো আছে স্কুল গেটের খানিকটা ওপরে। লোহার খয়েরি গেটের ওপর হলুদ রঙে বড় বড় করে লেখা ইউনিভার্সাল মডেল স্কুল। শুধু শহর নয় রাজ্যের মধ্যেও যথেষ্ট নামকরা এই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটি। সুমিদের গাড়িটা থেমে গেল গেটের ঠিক সামনে। এর আগে কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত উঠলেও, ওদের স্কুল এ বছরই প্রথম বার এই প্রতিযোগিতায় ফাইনালে উঠেছে, সুমি রায় আর শ্রুতি বসু বিনোদিনী বালিকা বিদ্যালয়কে রিপ্রেজেন্ট করছে। প্রাইমারি রাউন্ড গুলোতে ছ'টা করে গ্রুপ এ্যাপিয়ার হয়েছে । কোয়ার্টার ফাইনালে ওদের গ্রুপে সবকটাই বাংলা মিডিয়াম স্কুল ছিল। ইংরেজিতে বক্তব্য রাখতে হলেও ওরা ম্যানেজ করে নিয়েছে। সেমিফাইনালে ওরা মানে বিনোদিনী গার্লস আর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল উঠে এসেছে। অন্য সেমিফাইনালে উঠেছে আরও দুটো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল।
সৌমি আর তৃষা দুজনেরই মুখের চেহারা বেশ শুকনো, নার্ভাসনেসে বারবার ওদের জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে, আর এক ঢোক করে জল খেয়ে গলা ভেজাচ্ছে। জীবন বিজ্ঞান দিদিমণি বাসন্তী ম্যাম গাড়ি থেকে নেমে ওদের ডাক দিলেন,
"কইরে! নেমে আয় গাড়ি থেকে। কী হল তোদের "?
সুমি ক্লাস নাইন আর শ্রুতি ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী। দুজনেরই পরণে স্কুল ইউনিফর্ম, পিন করে পরা মেরুন পাড় সাদা রঙের শাড়ি , মেরুন ফিতে বাঁধা চুল, সাদা মোজা আর খয়েরী কেডস্, বুকে স্কুলের ব্যাজ আর গলা থেকে ঝুলছে হলুদ রিবনে বাঁধা ডিবেট প্রতিযোগিতার এন্ট্রি কার্ড। সুমির ভয়ে হাত ঘামছে, শ্রুতি আর সুমির হাত ধরাধরি করে গাড়ি থেকে নামে, শ্রুতি নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে বলে,
" ভয় পাচ্ছিস কেন? এতদূর এগিয়েছি যখন আমরা ঠিক পারব!"
ম্যাম এগিয়ে আসেন, ওদের কাঁধে হাত রেখে ভরসা দেন, বলেন,
"দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। অংশ নেওয়াটাই আসল, ভয় কাটিয়ে অংশ নাও, তোমাদের রেজাল্ট ঠিক ভালো হবে।"
প্রতিযোগিতা শুরু হতে তখনও এক ঘণ্টা দেরি আছে।সমস্ত প্রতিযোগীদের একটা ঘরে বসানো হয়েছে। অডিটোরিয়ামটা বিশাল, সাদা দেওয়ালে স্কুলের ছাত্রদের পাওয়া পুরস্কারের নানান ছবি, নীলের ছিটওয়ালা ধপধপে সাদা টাইলসের মেঝে, বড় স্টেজের ওপর প্রতিযোগীদের বসার জায়গা, সব মিলিয়ে সুমিকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর প্রতিযোগীরা নিজেদের মধ্যে আলাপ পরিচয় করছিল, কিন্তু সুমি একপাশে চুপ করে বসে ছিল। শ্রুতি আগের বছরও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল, তাই ওকে খানিকটা স্বাভাবিক লাগলেও সুমি এই বছর প্রথম এসেছে। শ্রুতি অন্য প্রতিযোগীদের সাথে কথা বলছে । সুমির একা একা বসে মনে হচ্ছিল সকলেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে,ওকে নিয়ে কথা বলছে। ওদের বিনোদিনী গার্লস বাংলা মিডিয়াম হলেও যথেষ্ট নামকরা স্কুল , মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট হয় স্কুলের, সুমি নিজেও ক্লাসে পাঁচ জনের মধ্যে থাকে, কিন্তু আজ ফাইনাল রাউন্ডে উঠে সুমির আত্মবিশ্বাস যেন তলানিতে পৌঁছে গেছে।
সব ছেলে মেয়েরা যখন হৈচৈ করে কথা বলছে, সুমি একা বসে আছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে শ্রুতি কে চোখে পড়ে না ওর ! সুমি আপনমনে বসে নিজের জীবনের লড়াইয়ের কথা ভাবে। সুমির ছোটোবেলা কেটেছে বড় দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে। ওর বাবা ট্রেনে হকারি করতেন। এক বর্ষার রাতে বাবা ট্রেনেই কাটা পড়ে মারা যায়, সুমি তখন বড়োই ছোটো, ওর তখন মাত্র ন’বছর বয়স । পড়তো পাড়ার একটা অবৈতনিক স্কুলে, ফোর পর্যন্ত সেখানেই পড়েছে। বাবা মারা যেতে ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, মা লোকের বাড়ি রান্না করে, বাসন মেজে নিজেদের পেটের ভাতের জোগাড় করতেন, সুমিকে পড়াবেন কোথা থেকে। এরপর মা হঠাৎই বিনোদিনী গার্লস স্কুলের কমলা দিদিমণির বাড়ি রান্না আর বাচ্চা দেখার কাজ পায়। কমলা দিদিমণি স্কুলে অঙ্কের টিচার ছিলেন। কমলা দিদিমণির এক বছরের ছেলেকে মা দেখাশোনা করত। সুমি মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সকাল থেকে ঘুরত, কমলা দিদিমণি বাড়ি ফিরে এলে রাতের রান্না করে রেখে নিজেদের রুটি তরকারি নিয়ে মা আর সুমি বাড়ি ফিরত।
বাসন্তী দি এসে খবর দিলেন,
“ তোমরা তৈরি তো? আর আধ ঘন্টার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হবে।" জানালেন “স্কুল থেকে আরও কয়েকজন দিদিমণি আর ছাত্রীদের নিয়ে বড়দি এসে গেছেন।"
সেদিনের কমলা দিদিমণিই আজকে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। সুমির জীবনে কমলা দিদিমণি আর ওনার স্বামী ভগবান হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। সুমি আজও সেই দিনটার কথা ভুলতে পারে না, ফ্রিজ থেকে শাক বার করে মা কাটতে বসেছিল
সুমি রান্নাঘরের সামনে বসে পুরোনো খবরের কাগজ খুলে আঙুল দিয়ে রিডিং পড়ছিল। কমলা দিদিমণির স্বামীর চোখে পড়ে যায়। এতদিন সেভাবে ওঁরা সুমি কে খেয়াল করেননি। রাশভারী মানুষটা সুমি কে ঘরে ডাকেন,
“ এই মেয়ে, এখানে শুনে যা’।
সুমি ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়ায়, হাতে খবরের কাগজ, সেখানে কমলা দিদিমণিও ছিলেন। উনি আর ওনার স্বামী দুজনেই ওকে রিডিং পড়তে দিলেন, একটা খাতায় অঙ্ক করতে দিলেন কমলা দিদিমণি। সুমির মাও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের দরজায়, মেয়ে কি ভুল করেছে,মুখে সেই আতঙ্কের ছাপ। এই চাকরিটা চলে গেলে মেয়ে নিয়ে আতান্তরে পড়তে হবে বেচারিকে। সুমি ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও যতটুকু জানে উত্তর দিয়েছিল। কি দেখেছিলেন কি বুঝেছিলেন কমলা দিদিমণি, পরের দিনই সুমি আর ওর মাকে বিনোদিনী গার্লস স্কুলে নিয়ে এসে কথা বলেছিলেন, পরের সেশনে সুমি ফাইভে ভর্তি হয়েছিল।
নতুন স্কুল, ক্লাসের মেয়েদের থেকে সুমি বয়সে সামান্য বড়োই ছিল,তার ওপর রান্নার মাসির মেয়ে, ওর মতো ঘরের মেয়েরা এত বড় স্কুলে সুযোগ পায় না। সুমির খুব একটা বন্ধু বান্ধব হয়নি, টিফিনের সময়ে একা একা বসে রুটি গুড় বা আলু ভাজা রুটি খেত, আর চোখের জল মুছতো। কমলা দিদিমণিই ওকে বুঝিয়েছিলেন,
“ এই সব কিছুর উত্তর কেঁদে বা মুখে নয়, ভালো করে পড়াশোনা করে দিতে হবে তোকে।"
এই পাঁচ বছর সুমি আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। পরীক্ষায় প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে থাকে, কিন্তু খুব ভালো ডিবেট করে, ভালো বক্তৃতা দিতে পারে, আবৃত্তি করে,আল্পনা দিতে পারে। আজও ওর বেশি বন্ধু নেই, কিন্তু স্কুলের যেকোনো অনুষ্ঠানে সুমি কে দরকার হয়। কিন্তু তবুও আজ ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের সাথে প্রতিযোগিতায় সুমি ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হচ্ছে। আসলে অনেকের দ্বিধা ছিল ওর নির্বাচনে। সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে বড় দিদিমণি ওকে এখানে পাঠিয়েছেন। মনে মনে মা সরস্বতী কে প্রণাম করে বলে,
“আমায় শক্তি দাও ঠাকুর, আমরা যেন স্কুলের সম্মান রাখতে পারি।"
ধীরে ধীরে শান্ত হয় সুমি, চোখ বুজে নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।
বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। লটারি করে প্রতিযোগিতার বিষয় নির্বাচন করা হয়েছে। বিষয় মাতৃভাষায় শিক্ষা। প্রত্যেক স্কুল দু-বার করে বলার সময় পাবে। সব প্রতিযোগীরাই একে একে নিজেদের বক্তব্য রাখছে। বিনোদিনী গার্লস থেকে শ্রুতি নিজেদের বক্তব্য রেখেছে প্রথম রাউন্ডে। এবার সুমির পালা,ফাইনাল রাউন্ডে বলতে উঠে প্রিয় বিষয়টা পেয়ে সুমি উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না।উঠে দাঁড়িয়ে সঞ্চালক, বিচারকমণ্ডলী, আয়োজক স্কুল কর্তৃপক্ষকে অভিবাদন ও সাথী প্রতিযোগীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে সুমি নিজের বক্তব্য রাখতে শুরু করে,
“মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম। আর মাতৃদুগ্ধে শিশুর প্রথম অধিকার আমরা যেমন অস্বীকার করতে পারিনা, ঠিক তেমনই শিক্ষার সাগরে অবগাহন করতে গিয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভই সহজতম ও আনন্দময় হয়ে ওঠে।
সুমির আগে পক্ষে বিপক্ষে সমস্ত প্রতিযোগীরাই তাদের বক্তব্য ইংরেজিতে রেখেছে।অডিটোরিয়ামে আর প্রতিযোগীদের মধ্যেও হালকা গুনগুন শব্দ উঠতে শোনা গেল। বিচারকরাও যেন একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকান। সুমি কোনো দিকে তাকায় না। সময় যে বাঁধা-ধরা।
...বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের আত্মাহুতি, আধুনিক কমপিউটারে বাংলা লেখার জন্য অভ্র কীবোর্ড আবিষ্কার, সবকিছুই ছু্ঁয়ে যায় নিজের কথায়। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেও ভারতবর্ষে ―যেখানে এখনও নিম্নবিত্ত শ্রেণীই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে তাদের সাথে নিয়ে চলতে চাইলে মাতৃভাষা কে সঙ্গী করে চলতেই হবে, নাহলে আমাদের দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধন সম্ভব হবে না“, নিজের বক্তব্য শেষ করে সুমি। অডিটোরিয়াম জুড়ে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিচারকরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা সেরে তাড়াতাড়িই মঞ্চে এলেন। বক্তব্য রাখার যোগ্যতায় তৃতীয় এবং দ্বিতীয় পুরস্কার দেওয়ার পর প্রথম পুরস্কার ঘোষণা করার পালা। বিচারকরা সানন্দে ঘোষণা করলেন আজকের বিজয়ী বিনোদিনী গার্লস স্কুল । এও জানালেন, সুমির বিতর্কের বিষয়ের পক্ষে বাংলায় বক্তব্য রাখার প্রাসঙ্গিকতা ছু্ঁয়ে গেছে বিচারকদের মন। শ্রুতি জড়িয়ে ধরে সুমিকে। সুমি আর শ্রুতির গলায় মেডেল পরিয়ে হাতে ট্রফি তুলে দিলেন বিচারকরা। কমলা দিদিমণির চোখে জল, পৌঁছে গেছেন স্টেজের সামনে । পুরো অডিটোরিয়াম তখন ফেটে পড়ছে হাততালির শব্দে।
-বিজয়লক্ষ্মী মুখার্জী