Image-Description
Stories
মহাভাগে
Feb 10 2024 Posted by : montajpublishing

সময়টা গত শতাব্দীর সত্তরের দশক। তখন স্কুলের সরস্বতী পুজোই ছিল প্রধান। বাড়ির মতো, স্কুলটাও নিজের মনে হতো।

 সে বছর আমি ক্লাস নাইন। টেনের দিদিরা দায়িত্ব নিতে পারছে না, কারণ সামনেই মাধ্যমিক। আমাদের ক্লাসে, আমার ডাক পড়ত, যে কোনও দরকারে। কারণ পড়াশোনাটা আমি কোনদিনই নম্বরের জন্য করিনি। প্রাণ ভরে শিখতাম যা পেতাম। সে সেলাই থেকে খেলা, বাদ যেত না কিছুই।

              সেবার সরস্বতী পুজোয় আমার ভার ছিল আলপনা দেওয়ার। মনের মতো করে আলপনা দিলাম। একটা টেবিল ক্লথে দুটো ময়ূর করেছিলাম উল দিয়ে। সে দুটোই এঁকেছিলাম। 

সরস্বতীর মূর্তি ছিল শ্বেতবস্ত্রা, আলতা পরা দুটি পা যেন পদ্মফুল। শাড়ি নীল ফেব্রিকের ছোট্ট ছোট্ট ফুলে সাজিয়ে তুললাম। আমার খুব পছন্দের কাজ ছিল এসব। সেদিন রাত জাগার ইচ্ছে আমাদের। হেডমিসস্ট্রেস ম্যামকে বলতে উনি পারমিশন দিলেন। 

            বাণী, রিঙ্কু,ছবি আর আমি থাকব ঠিক হল। হৈ হৈ করে গিয়ে ধরলাম দারোয়ান মঙ্গলকাকুকে। উনি এক ছেলে নিয়ে থাকতেন স্কুল বাউন্ডারির সাথে লাগোয়া ছোট্ট ঘরে। বাড়ি বিহারে। বললাম,

“রুটি আর ডাল হলেই চলবে।”

 হাসিমুখে রাজি হয়ে গেলেন। সেদিন যত্ন করে ‘চানেকা সবজি ঔর রোটি’ বানিয়েছিলেন। কী যে অমৃত লেগেছিল খেতে। ওঁর ছেলে আমাদেরই বয়সী। নাম শঙ্কর। খেতে খেতে গল্প করছিল।

বিহারে ও যখন পড়ত তখন সরস্বতী মাঈকির পুজো দেখেছিল। ওর একটা বোন ছিল, তাকে নাকি সরস্বতী মায়ের মতোই ছিল দেখতে। এখন সে, না ফেরার দেশে। তবে ওদের গ্রামে ঘুড়ি উড়ত সেদিন!

খেতে খেতে রাত হয়েছিল। সাজানো কিছু বাকি, চটপট হাত লাগালাম। ঝলমলে শাড়ির সাথে মুখটা একটু ম্লান লাগছিল যেন। কী করা যায়! অভ্র মাখিয়ে ম্যানেজ করা গেল। মায়ের মুখটি বেশ উজ্জ্বল হল এবার। শুতে হবে, রাত হয়ে গেছে অনেক। শেষ বারের মতো দেখে নিতে গিয়ে মনে হলো, একটা আঙটি দিলে হয়। রূপোলি রাংতার ফুল জুড়তে হবে! হাতের আঙুলে আর পায়ের আঙুলেও…

যাঃ! বাঁ পায়ের আঙুল ভেঙে গেল!

ছাঁৎ করে উঠল বুকটা। কী হবে এখন? সবাই মিলে কোনোরকমে আঠা দিয়ে জুড়ে দিলাম। শাড়িটা ঠিক করে চাপা দিয়ে দিলাম।

               স্কুলের বড় আলোগুলো নিভিয়ে দিয়ে মালার মতো টুনিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন মঙ্গলকাকু। তিনতলা থেকে মাঠের ঘাস পর্যন্ত নেমে এসেছে নীল আর গাঢ় হলুদ টুনির মালা। বারান্দায় সবুজ আর লাল টুনি সার দিয়ে আটকে দিয়েছেন ইলেক্ট্রিক কাকু। একটা আলো আঁধারের খেলা স্কুল জুড়ে। ভাবলাম দেখে আসি একবার ঘুরে। রিঙ্কুকে নিয়ে চললাম। 

                 দোতলায় উঠে দেখি টানা বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে আছে শঙ্কর। বললাম, “কী হল শঙ্কর?”

মুখটা কেমন শুকনো, বলল,”কুছু নাহি!” নেমে যাচ্ছিল, ফিরে তাকিয়ে বলল, “তোড় দিয়া পয়ের?”

চোখ বড়ো হয়ে গেল আমাদের। ও কী করে জানল ? বললাম, “তুম দেখ রহে থে?”

ও চুপচাপ নেমে গেল।

          আমরা তিনতলায় উঠলাম। চিকচিক আলো জ্বলা নিস্তব্ধ বারান্দা। বড়ো বড়ো দরজাগুলোয় ফুলের তোড়া। আর চেনা স্কুলটা নেই। কোথাকার যেন স্বপ্নপুরী, এখনই কোনো একটা দরজা খুলে রাজকুমারী বেরিয়ে এলেও আশ্চর্য হব না। 

রিনরিনে চুড়ির শব্দ যেন?

চকিতে দাঁড়িয়ে গেলাম। টুনির মালা হঠাৎ হাওয়ায় দুলে উঠে বুঝিয়ে দিল, শীতটা এখনও পুরোপুরি যায়নি। 

নীল হলুদ আলোর গোল গোল বল যেন দুলুনির তালে তালে অন্ধকারকে নিয়ে খেলতে লাগল! গা ছমছম করে উঠল, তাড়াতাড়ি নেমে এলাম। 

           পরের দিন পুজো হয়ে গেল সকালে। আবার আজ রাতে থাকা। বাড়ি থেকে ফ্রেশ হয়ে এলাম। দুদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীর। বেঞ্চ জুড়ে কার্পেট পেতে শুয়ে শুয়ে গল্প করছি। বেশিক্ষণ জাগতে পারলাম না। হলের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। 

           কিসের যেন শব্দে, ঘুম ভেঙে গেল! উঠে এলাম। চোখে পড়ল, ঠাকুরের সামনে ঘরজোড়া আলপনা জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। ভাবলাম ঠিক করে দিই। এটা ওটা সরাতে গিয়েই দেখলাম জিনিসটা! একটা লাল ফোঁটা। ঠিক রক্তের মতো। একটু দূরে পায়ের ছাপ! বাঁ পায়ের লাল ছাপ!

মনে পড়ল চুড়ির রিনরিন! কাঁপা হাতে ফুল সরাতে আরো একটা। কয়েকটা লাল ফোঁটা! দুরুদুরু বুকে একটু খুঁজতেই দেখলাম আবার…

             আমি বিহ্বল হয়ে ঠাকুরের মুখে তাকাই, চিকচিকে অভ্রমাখা মুখে হাসির ঝিলিক...আমার বুক থেকে হৃদয়টা এক্ষুনি বেরিয়ে আসবে, ছাপ চলে গেছে, যেখানে বইগুলো রাখা ছিল, সেই দিকে। একটা একটা করে ওঠাতে থাকি। আমার বইটা তুলেই, দম আটকে এল! পিছনের মলাটে পায়ের ছাপ...আমি বসে পড়লাম সরস্বতীর পায়ের তলায়, হু হু করে কেঁদে উঠলাম…

মূর্তির ঠোঁট নড়ে উঠল,

— কী হল! কী হল! কাঁদছিস কেন ?” 

আমি চোখ খুললাম। ঝুঁকে আছে বীণা আর ছবির মুখ। ওরা আমায় ঝাঁকাচ্ছে।

ছুটে গেলাম ঠাকুরের কাছে, কই নাহ! কিছু তো নেই! পা ঠিক আছে। শুধু মুখটিতে লেগে আছে ভুবন ভোলানো হাসি…

রাতের রঙ কি পাল্টে গেছে, হাওয়া কি বদলে গেছে, একেই কি স্বর্গ বলে ? 

কোথা থেকে যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে,"সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমল লোচনে..."

             পরে অবশ্য আমার বইয়ের ওপর একটা চেপ্টে যাওয়া গাঁদা ফুল দেখে, ওটাই আশীর্বাদ বলে রেখে দিয়েছিলাম। আর রেজাল্ট?

 হাঃ হাঃ হাঃ ! ঐ যেমন হয় আর কী !

-রাণু শীল


Popular Books


Comments

  • বিজয়লক্ষ্মী মুখার্জী

    সুন্দর গল্প, মেয়েবেলার গন্ধ মাখা। আর লেখিকা তো সত্যিই সরস্বতীর আশীর্বাদ পেয়েছেন

    Feb 10 2024
  • Satabdi Chakraborty

    দুর্দান্ত লাগলো। এই যে সরল গল্প অথচ একটু গা ছমছম করে উঠল। না না মা সরস্বতীর আশীর্বাদ ভরপুর আছে আমাদের সোনা মা'র মাথায়। খুব ভালো লাগলো।

    Feb 10 2024
  • Sulagna Banerjee

    বড়ো সুন্দর লাগলো

    Feb 18 2024
  • jliksJdWQ

    BcSuUoIvbWP

    Mar 14 2024
  • jliksJdWQ

    BcSuUoIvbWP

    Mar 14 2024
  • jliksJdWQ

    BcSuUoIvbWP

    Mar 14 2024

Write a Comment