Image-Description
Stories
বৃক্ষমঙ্গল
Jun 17 2024 Posted by : montajpublishing

এই যে শুনছ, আমি তোমাদের পুটপুট! আমাকে ভুলে যাওনি নিশ্চয়ই। অনেকদিন পরে তোমাদের কাছে এলাম। কী করব বলো, গরমের ছুটিতে আমি যে মায়ের সঙ্গে বেড়াতে চলে গিয়েছিলাম। জানো তো, জঙ্গলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সে এক আশ্চর্য জায়গা।
মায়ের এক বড়ো দাদা, বনবিভাগের অধিকর্তা। জঙ্গলের একেবারে গায়েই তাঁর আস্তানা। সেই কবে থেকে ওখানে বেড়াতে যেতে বলেন! এবারে গরমের ছুটি পড়তেই, মা বলল, 
 "চল্, ঘুরেই আসি। ক'টা দিন বেশ নিরিবিলিতে কাটানো যাবে।"
আমার আবার ওই ব্যাপারটাই বিশেষ অপছন্দ। বকবক করতে না পারলে হাঁফিয়ে উঠি। ওদিকে মামাদাদুর বাড়িতে ছেলেপুলেরাও কেউ নেই। কোথায় যেন পড়াশোনা করতে চলে গিয়েছে সবাই। তাহলেই বুঝতে পারছ, কী কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার! তবে ওখানে পৌঁছে দেখি যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, ততটাও খারাপ নয়। 
প্রথমেই নজরে এল, খাবার ঘরের তাকে রাখা বয়াম ভর্তি একগাদা চকোলেট! সে সব নাকি আমারই জন্য।  শহর থেকে অনেকটা দূরে বনের কাছাকাছি ওঁদের কোয়ার্টার তো, বলা যায় না, হঠাৎ যদি বায়না করে বসি! বোঝাই গেল, বেশ বিবেচক লোকজন এঁরা। 
এখানে সবই ভালো, কেবল একটাই  মুশকিল, আমি তো চেনা অচেনা সবার সঙ্গেই বকবক করতে ভালোবাসি, এখানে কথা বলার জন্য কাউকে বিশেষ পাব বলে তো মনে হয় না, সামনের রাস্তাটা দিয়ে লোকই তো যায় না। 
       বাংলোটা অবশ্য খুব সুন্দর। তার চারপাশে লাল সুরকি ঘেরা পথ। টবে সুন্দর পাতাবাহার গাছ।  ফটকের বাইরে, একটা সরু পিচের রাস্তা, সেটা পেরিয়েই, সামান্য একটু দূর থেকে বড়ো বড়ো গাছপালা, জঙ্গলের ভিতর দিকে হাঁটা দিয়েছে।
    ডিনারের পরে মায়ের আঁচল ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। গা ছমছমে অন্ধকার জঙ্গলের দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। টিপ টিপ আলো উড়ে বেড়াতে দেখে ভয় ভয় করছে। মা বলল, "দূর বোকা, ওগুলো তো জোনাকি।"  
গাছের মাথায় একফালি চাঁদ উঠতেই কেমন আবছা আলোয় ভরে গেল চারপাশ, এমন রাতেই কী পরীরা  পৃথিবীর বুকে খেলতে নামে! তাদের হাতে বুঝি থাকে জাদুকাঠি! ভাবছিলাম না ঘুমিয়ে বারান্দায় বসে থাকলে কী দেখা পাব তাদের। আমায় দেখে নিশ্চয়ই খুশি হবে তারা। কতদূর থেকে এসেছি! 
রাতচরা পাখিরা দলবেঁধে উড়ে গেল। হঠাৎ একঝলক  নাম না জানা ফুলের গন্ধ আদর করে জড়িয়ে ধরল আমায়। 
   হঠাৎ খুব ঘুম পেতে থাকল, কলকাতায় তো সহজে ঘুমই আসে না, মা টানতে টানতে বিছানায় নিয়ে যায়! আজ আর জেগে থাকা যাচ্ছে না, কাল ঠিক পরীদের নাচ দেখব,এখন শুতে যাই। শীতল বাতাস কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল, আশ্চর্য, এসি-র  কথা মনেই এল না!          
পরদিন সকাল হতেই দেখি সাইকেলের হ্যান্ডেলে দুধের ক্যান ঝুলিয়ে দুধ দিতে এসেছেন একজন কাকু। এ আবার কেমন দুধ! প্যাকেটে নয়, ক্যানে করে টাটকা দুধ এনে মগে করে মেপে বাটিতে ঢেলে দিয়ে যান। 
"ও রামেশ্বর, মংলুকে একটু পাঠিয়ে দাও না, আমাদের পুটপুটের সঙ্গে খেলবে।" বললেন বড়োমামী। 
 "জী মাইজি।" বলে, চলে গেলেন দুধকাকু। 
একটু পরেই দেখি ঢলঢলে প্যান্ট আর বোতাম ছেঁড়া জামা পরা, আমার চাইতে একটু বড়ো একটা ছেলে গুলতি হাতে এসে হাজির।
প্রথমে ভাবটা ঠিক জমছিল না, তারপর যেই না, ও গুলতি দিয়ে এক টিপে ডাল থেকে পেয়ারা পেড়ে দিলো, অমনি ভাব হতে আর দেরি হল না।
     আজকাল ও রোজ আসে। জলখাবার খাবার খেয়ে, আমাকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। জঙ্গলের বুক চিরে জিপ যাবার একটা পিচ-রাস্তা  চলে গিয়েছে। আমরা সেই রাস্তা ধরে কিছুটা এগোই, তারপর রাস্তা ছেড়ে চুপিচুপি জঙ্গলে ঢুকে যাই। ও আমাকে কত্ত কিছু দেখায়! মৌচাকে বিজবিজ করতে থাকা মৌমাছির দল, নুড়িপাথর ডিঙিয়ে, কুলকুল আওয়াজে গান গেয়ে বয়ে চলা ঠান্ডা জলের তিরতিরে নদী, জল খেতে আসা জানোয়ারদের নুনচাটার পাথর। জানোয়াররা নাকি সন্ধ্যাবেলায় জল খাওয়ার আগে নুন খায়! বোঝো কান্ড। এছাড়াও বাবুইপাখির বাসা, কাঠঠোকরা পাখি, গাছে গাছে কাঠবিড়ালি, আরও কত কী! সেদিন তো পেল্লায় একখানা গাছ দেখিয়ে বললে ওটা নাকি শিশুগাছ। শুনে তো আমি হেসেই মরি,আর কলকে ফুলের মধু! সে-ও খেতে কী দারুণ! একটু ভিতরের দিকে গাছপালারা যেখানে গলা জড়াজড়ি করে থাকে সেই ঘন বনের জায়গাটা, কেমন সবুজ আলোয় ভরা। মংলু বললে, জ্যোৎস্না রাতে পরীরা নদীর জলে স্নান করে এইসব জায়গায় খেলা করতে আসে। তাই তো এমন মায়াভরা আলো। যাই বলো জঙ্গল ব্যাপারটা  কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং! ইস্, মংলুর মতো আমারও যদি  একটা জঙ্গল থাকত! এখান থেকে চলে যেতে হবে ভাবলে, আমার আজকাল বেশ মন কেমনই করে। 
         দিনগুলো হু হু করে চলে গেল। কয়েক দিন বাদে বাবা, আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হাজির।
 জঙ্গলের জন্য মন খারাপের কথা শুনে বাবা বলল, 
"বেশ তো, এই বর্ষাতেই, আমরা বাড়ির আশেপাশের পোড়ো জমিতে প্রচুর গাছপালা লাগাব, যত্ন করে বড়ো করব। সেখানেও কত পাখি আর কাঠবিড়ালির দল আসবে।"
তাই শুনে বড়োমামা বললেন, "তোমরা তাহলে আর ক'টাদিন থেকেই যাও। সামনের হপ্তায় কিছু  স্পেশালিস্ট আসছেন, 'সিড বম্ব' তৈরী করা শেখাতে।"
"সেটা আবার কী?" বড়োমামা বুঝিয়ে বললেন, কিছু ধরণের ফল আর বুনো ফুলের বীজ একসঙ্গে করে, সার মেশানো নরমমাটির মধ্যে ভরে বলের মতো বানিয়ে চড়া রোদে শুকিয়ে নিয়ে তৈরী হয় সিডবম্ব। সেগুলো যত্ন করে রেখে দিতে হয়। বর্ষাকালে সুবিধামতো মাঠঘাট, পোড়ো জমিতে, সেগুলিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলাকে বলা হয়,'সিড বম্বিং'। বর্ষার জলে ভিজে মাটির আস্তরণ খসে গিয়ে, সেইসব বীজ থেকে নতুন গাছের উদ্ভব হয়। এইভাবেই পোড়ো জমিতে গাছপালা লাগিয়ে ধীরে ধীরে বনসৃজনের পথে এগিয়ে যাবার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমনকি ট্রেনে অথবা গাড়ি করে যাবার সময় মাঠেঘাটে ওইভাবে সিড বম্বিং করার কথা প্রচার করছেন তাঁরা। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর হাত থেকে বাঁচার এটাই একমাত্র পথ। মফস্বল শহরের ইস্কুলের ছেলে মেয়েদের এইসব ট্রেনিং দেওয়া চলছে, কারণ সেখানেই তো প্রচুর মাঠঘাট আর পোড়োজমি। 
শুনে বাবা বললো, "ইনটারেষ্টিং!"
     নতুন জিনিস শিখে টিখে আমরা তো ফিরে এলাম। 
ব্যপারটা কিন্তু এইখানেই শেষ হল না। 
ক'দিন বাদেই আমাদের ইস্কুল খুলল। প্রথমদিন পড়াশোনার চাপ নেই। আমাদের একজন নতুন মিস এসেছেন। 'কে কীভাবে ছুটি কাটাল?'  জিজ্ঞেস করছিলেন সবাইকে। আমি সবে, সিডবম্ব-এর গল্প বলতে গিয়েছি, পুরোটা না শুনেই তিনি ঘাবড়ে টাবড়ে গিয়ে একাকার। সোজা হেড ম্যামের কাছে নালিশ করলেন। 
একে জঙ্গল, তায় বোমা! কে জানে আমি কাদের পাল্লায় পড়েছিলাম! আর রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না ভেবে মায়ের কাছে খবর গেল। ফোনে সবটুকু বোঝানো যাবে না বুঝে মা ইস্কুলেই চলে এল। বাবাকেও মা আসতে বলেছিল। তারপর দুজনে মিলে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলায় তাঁরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। 
হেডম্যাম্ বোধহয় ব্যাপারটা সম্পর্কে আগেও কিছুটা শুনেছিলেন। বাবাকে বললেন ওই পরিবেশবিদদের ঠিকানা জোগাড় করে দিতে। আমাদের ইস্কুলেও নাকি ওই প্রোগ্রামটা হবে। উঃ কী যে আনন্দ হচ্ছে! ফল, ফুল পশু পাখি সবাইকে নিয়ে পৃথিবীটাকে গরমের হাত থেকে বাঁচাতে হবে তো, না কী বলো!

-সুমিতা দাশগুপ্ত


Popular Books


Comments

  • Sarmishtha Chatterjee

    মজার গল্প

    Jun 17 2024
  • Vijay Lakshmi Mukherjee

    বাহ,খুব ভালো লাগলো

    Jun 17 2024

Write a Comment