এবার পুজোয় রতনের একটা মাত্র জামা হয়েছে। রতনের স্কুলের দিদিমণি যখন জিজ্ঞেস করল, সবাই তিনটে চারটে করে জামার কথা বলল, বিনোদ বলল, পাঁচটা, রোহিত বলল, ন'টা। রতনের খুব লজ্জা করছিল। কোনোরকমে ও বলেছিল একটা। ক্লাসশুদ্ধ ছেলের মধ্যে একটা চাপা হাসির রোল উঠেছিল, রতন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল। গতকাল মোড়ের মাথার সেলুনের অনিলকাকুও জিজ্ঞেস করল, রতন যেন শুনতেই পায়নি এমন ভান করে ছুটে চলে গেল।
মায়ের উপর খুব অভিমান হল, রতনের। কিন্তু জানে মায়ের কিছু করার নেই। বাবা যখন বেঁচে ছিল রতনের খান তিনেক জামা তো হতই। তাছাড়া পুজোর সময় ঠাকুর দেখা, নাগরদোলা চড়া, এগরোল খাওয়া, খেলনা কেনা সবরকম ফুর্তিই হত। এখন সব আনন্দ কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। মা এখন একটা হাসপাতালে আয়ার কাজ করে। ছুটিছাটা প্রায়ই পায়না। পুজোয় মাত্র দুদিন ছুটি মায়ের। মা আজকাল খুব ক্লান্তও থাকে। তাই খুব একটা ঘোরাঘুরি হয়না। রতন নিজেই পাড়ার পুজোর প্যান্ডেলে গিয়ে বসে। কত লোকজন ছেলেবুড়ো মেয়েরা সব সেজেগুজে ঠাকুর দেখতে আসে। রতনের সেসব দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু আগের মত মজা তো আর হয়না।
তাও গতবছর অব্দি মা দুটো জামা কিনে দিয়েছিল। এবার স্রেফ বলে দিল, যা দিলাম তাই পরবি। এর চেয়ে বেশি এবার পারব না।
মাও কেমন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। কিছু বলার সুযোগই দিল না।
স্কুল ছুটি পড়ে গেল। রতন অন্যান্যবার সেজেগুজে সকালের দিকে পাড়ার বন্ধুদের বাড়ি যায়। এবার কোথাও গেল না। বিনোদ ওর খুব বন্ধু। ওরও প্রতিবার দুটো জামা হয়। সকালবেলাটা বিনোদের সাথেই বেরোয় ও।এবার পাঁচটা জামা হয়েছে শুনে বিনোদকে মনে মনে আড়ি দিয়েছে । বিনোদদের বাড়ির ধারেকাছে সে এবার যাবে না। পুজোয় দেখা হয়ে গেলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে। ও একা একাই বেরোবে।
সপ্তমী চলে গেল। নতুন জামাটা পরা হয়ে গেছে। পুজোর বাকি চারদিন এক জামা পরে ঘুরতে হবে ভেবে ওর কান্না পাচ্ছে। গতবারের একটা জামা এখনও ভালো আছে। সেটাকেই কেচে শুকিয়ে তোষকের তলায় রেখে ইস্ত্রি করে পরবে ভাবছে। ও হ্যাঁ, রতন ইস্ত্রি বলতে তোষকের তলায় চাপা রাখাই বোঝে।
পুরনো জামার কথা ভাবতেই মনে পড়ল বিলুর কথা। ন'পাড়া বস্তির পেছনে ওদের ঘর। একটাই ছোট ঘর। ও আর ওর মা থাকে। ও যখন খুব ছোট ওর বাবা কোথায় চলে গেছে। ওরা খুব গরীব। কোনো কোনো বছর ওর পুজোর জামা হয় না। তখন রতনের কাছে পুরোনো জামা চাইতে আসে। এবছর আসেনি। ভাগ্যিস। তাহলে হয়ত ওর পুজোর জামা হয়েছে। হলেও খুব বেশি তো হবে না। একটাই হবে। ওর সাথে বেরোলে হয়। ও অন্তত রতনকে নিয়ে হাসাহাসি করবে না।
এই ভেবে রতন বিলুকে ডাকতে ওদের বাড়ি গেল। বিলুর মা বাড়ি ছিল না। বিলু বসে বসে কি একটা ঝুঁকে পড়ে দেখছিল। রতন আসতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, রতনদা দ্যাখো আমার হাতে কী?
রতন দেখল, একটা বই। রতন একটু আশাহত হল। পুজোর দিনে বিলু বসে বসে পড়াশোনা করবে, তা রতন ভাবে নি।
– এই বইটা দ্যাখো। কী সুন্দর!
রতন ভাবছে, বই আবার সুন্দর কি করে হয়? বই তো পড়ে স্কুলে গিয়ে পড়া বলতে হয়।
– তুই এখন পড়াশুনা করছিস? তাহলে আমি যাই।
– না গো, এটা পরীক্ষার পড়ার বই নয়। রূপকথা। আমার মা যে বাড়িতে কাজ করে সেই মিষ্টিদিদিদের বাড়িতে এই বইটা আমি দেখেছিলাম। মায়ের সাথে একদিন গেছিলাম। মিষ্টিদিদির মা আমাকে সন্দেশ খেতে দিল আর বলল, এই বইটা বসে বসে পড়। আমি তো বই দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু জেঠিমাকে না বলতে সাহস হয়নি। তখন পড়তে গিয়ে দেখলাম, এই বইটা কি মজার। কি ভালো।
রতন স্কুলের বইয়ের বাইরে আর কিছু পড়ে নি। তাই অবাক হয়ে গেল। ওর বইটা হাতে নিয়ে একটু পড়তেই চমকে গেল। পাতায় পাতায় কত রহস্য। কোনো গল্পে রাজপুত্র গহীন অরণ্যে সাপের মাথার মণি খুঁজছে। সেই মণি ওর মায়ের চোখে ছোঁয়ালে ওর অন্ধ মায়ের চোখ ভালো হয়ে যাবে। কোনো গল্পে দুষ্টু ডাইনি বুড়ি চুড়িওয়ালি সেজে রাজবাড়িতে চলেছে রাজকন্যাকে চুরি করবে বলে। কোনো গল্পে কাঠুরিয়ার মেয়ের কান্না রোগ হয়েছে, খালি কাঁদে।
কেমন যেন অন্য এক জগতের হাতছানি দিচ্ছে এই বইটা।
বিলু বলল, সেদিন তো পুরোটা পড়া হয়নি। তাই মাকে এবার বায়না ধরেছিলাম, আমার পুজোর জামা চাইনা। আমায় এই বইটা কিনে দাও।
মা খুব রেগে গিয়েছিল। কিন্তু পুজোর জামার থেকে দামে কম বলে কিনেও দিয়েছে। চল, রতনদা আমরা দুজন বসে বসে এই বইটা পড়ি।
রতন বলল, পুজোর সকালে বাড়িতে বসে থাকবি কেন? চল পুজো মণ্ডপের উল্টোদিকে যে চেয়ারগুলো পাতা আছে সেখানে বসে বই পড়ি।
সেই মত দুজন বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ বিনোদ এসে হাজির। বলল, রতন তোকে একটা সত্যি কথা বলব, আমার না এবার পুজোয় একটাও জামা হয়নি রে। সবাই বেশি বেশি বলে, তাই আমিও পাঁচটা জামা বলে দিয়েছি।
রতন বিনোদকে জড়িয়ে ধরল। ও মনে মনে বিনোদের সাথে ভাব করে নিয়েছিল।
– বাদ দে। চল আমরা তিনজনে বসে বিলুর বইয়ের একটা দারুণ গল্প পড়ি। আর শোন, আমরা যেমন বই ভাগাভাগি করে পড়ছি, তেমনি জামাও পরব। আমার একটা জামা হয়েছে। আমি সপ্তমীতে পরেছি। আজ সন্ধ্যায় ঐ জামাটা পরবে বিলু। কালকে তুই। ঠিক আছে?
মা দুগ্গা তখন তাঁর ছেলেমেয়েদের বলছে, দেখেছিস, বিলু বিনোদ রতনরাই হল সত্যিকারের খাঁটি ছেলে। ওরাই একদিন দেশের দু:খ ঘোচাবে।
তনুশ্রী দাস