'টুইট টুইট'...ছোট্ট নীল-গলা মা পাখি, পাতার উপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিল একবার চারদিকটা। লাল টুকটুকে সূয্যি মামা তখন বিলের জলের উপর দিয়ে সবে উঁকি মেরেছে। তার লাল আবিরের ছোঁয়ায় বিলের জল, রং মেখে একেবারে একাকার। তীরের ছোট, বড় ঘাস ঝোপ শীতের নরম রোদ মাখছে আয়েশ করে। নাম না জানা কত ফুল ঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙছে সবে। কেউ বা দুলে দুলে গান গাইছে, লুটোপুটি খাচ্ছে সকালের মিঠে-কড়া রোদ্দুরে।
'গুড্ মর্নিং!' ― মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ঘাসফুলেরা সুপ্রভাত জানালো নীল-গলা পরিযায়ীকে। দুধ সাদা ঝরনার কোলে, পাহাড়ের গুহায়, পাথরের খাঁজে খাঁজে ডিম পাড়ে ওরা। ডিম ফুটে বেরোয় টুকটুকে সোনারা। ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে মা পাখি ছানাদের মুখে তুলে দেয় ছোট্ট ছোট্ট খাবারের কণা, ভরিয়ে দেয় সোহাগে ভালোবাসায়। পাখার তলায় ঢেকে রাখে বাছাদের, পাছে দুষ্টু বাজপাখিরা ক্ষতি করে ওদের। সেসব কথা মনে পড়লে, মা পাখির মনটা আজও দুলে ওঠে। তারপর মা-বাবা যত্ন করে শেখাতে থাকে সন্তানদের ওড়বার কৌশল। গরম শেষ হলেই আবার যে তাদের ফিরে যেতে হবে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে। তুষার-শুভ্র দেশ থেকে বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ, মায়ানমারের পথে। সেখানে এখান শীতকালের ওম ধরা আমেজ। প্রতিবারের মতন এবারেও নীল-গলা এসেছে তার দলবল নিয়ে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে। বাসা বেঁধেছে ঝিলের পারে নরম ঘাস জমির বুকের উপর।
'কী গো নীল-গলা বউ? কী ভাবছ এত!' ঘাসের মাথায দোল খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল গঙ্গা ফড়িং দাদা।
'কখন এলেন মশাই সুপ্রভাত, সুপ্রভাত।' একগাল হেসে মিষ্টি সুরে জানতে চাইল নীল-গলা বউ।
'গলাটা তোমার যেন মধু মাখা।' তারিফ করে ফড়িং দাদা বললে।
এরই মধ্যে কখন যেন ছানা দুটো বেরিয়ে এসে জলের ধারে খুনসুটি শুরু করেছে। মা তাদের গলা ছেড়ে ডাক দিল ― 'কোথায় গেলি বাছারা, ফড়িংখুড়ো এসেছে যে? আয় আয় তাকে একটু তোদের কচি গলার গান শুনিয়ে দিয়ে যা দিকিনি; বুঝলেন দাদা। ভোরবেলা উঠে একটু একটু রেওয়াজ শেখাচ্ছি বাচ্চাদের। আমাদের সমাজে গলার একটা আলাদা ইজ্জত আছে। দু একরকম নয় পাক্কা দশ পনের রকম পাখির গলা নকল করতে পারি আমরা।'
'তা জানিনা আবার। তোমাদের সঙ্গে পারবে কে? কী সুরেলা গলা তোমাদের নীল-গলা বউ।'
গঙ্গা ফড়িংয়ের কথায় একটু লজ্জা পায় মা পাখি; এরই মধ্যে কখন যেন উড়ে এসে বসেছে হলুদ রাঙা এক প্রজাপতি। ফুলের বুকে শুয়ে শুয়ে আয়েশ করে মধু খাচ্ছে সে। কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে এল এক ঝাঁক রোজি স্টার্লিং। সাইবেরিয়ার তৈগা অঞ্চল থেকে ওদের আবির্ভাব। দেশের লোকেদের দেখে নীল-গলা বউয়ের তো আর আনন্দ ধরে না।
'কখন এলে কখন এলে ভাই তোমরা? তা রাস্তার খবর সব ভালো তো?' নীল-গলা সুমিষ্ট স্বরে কিচমিচ করতে করতে গাছের নিচু ডালে নেমে এল। সবাই খুব উত্তেজিত। সবাই একসাথে কথা বলতে চায়।
রোজ স্টার্লিং দলের বুড়ো ঠাকুরদা গলা চড়িয়ে বলল ― 'রাস্তার খবর ভালো নয় বউ। আমাদের আসার পথে সে কী কাণ্ড! জঙ্গলে আগুন লেগেছে গো। গোটা তৈগার জঙ্গল পুড়ে একেবারে খাঁক। প্রায় এক শতক আগে যেরকম আগুনের কথা আমাদের বাপ ঠাকুরদারা গল্প করেছিল, ঠিক সেই রকম অবস্থা, নিজের চোখে দেখে এলাম গো বউ! সে কী আগুন আর কালো বিষাক্ত ধোঁয়া! কত পাখি যে উড়তে উড়তে ঝলসে যাচ্ছে তার শেষ নেই গো! আমুর লেপার্ডরা তো প্রায় শেষের পথে। এ বছর তাড়াতাড়ি রওনা দিয়েছিলাম তাই পৌঁছতে পারলাম। তা না হলে ব্ল্যাকবার্ড নয়তো কানাডিয়ান ওয়েবেলদের দশা হত বাছা।'
ওদের চেঁচামেচি শুনে কখন এসে জড়ো হয়েছে এক ঝাঁক পিনটেল আর বার-হেডেড গুজ্। বিলের জলে সাঁতার কাটতে কাটতে সব শুনছিল ওরা। বুড়ো সাইমেরিয়ান ক্রেন গলা ঝাড়া দিয়ে বললে—
'খুব খারাপ অবস্থা গো দিদিভাই। সাইবেরিয়ার উষ্ণতা ক্রমশ বাড়ছে, খবর পেলাম। রাশিয়ার পূর্ব দিকের ঝিলগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বৈকাল হ্রদেরও জল কমছে, গরম বাড়ছে খুব!'
সব শুনে চোখ গোল করে বললে নীল-গলা বউ ―
'কী জানে কী হচ্ছে দাদু! আমাদের সাইবেরিয়ার বাস, তৈগার বন, নীল জলে ভরা বিল, সবুজ ঘাসের জঙ্গল ― কেমন আছে কে জানে?'
ইতিমধ্যে সুয্যি মামা বেশ খানিকটা উঠে গেছে। গাছে গাছে ব্যস্ততা। ভোরাইয়ের সুরে কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে যেন। গোটা বিল জুড়ে জলের বুকে আলপনা এঁকে এগিয়ে চলেছে পিনটেল, হেরন, পানকৌড়ি, সাইবেরিয়ান ক্রেন। দেশি-বিদেশি দেহাতি সুরের মেলবন্ধন ঘটেছে যেন চারিদিকে। বাচ্চা দুটোকে জোর ধমক দিয়ে ঘরে আনে মা পাখি। ঘরটা বেশ সুন্দর করে বেঁধেছে এবার। বিলের ধার ঘেঁষে একটু নিরালায় মস্ত গাছের কোলে, ঠান্ডা ঘাসের মেঝেতে ঘরখানি। মাটির মধ্যে গর্ত করে রঙিন পাতা, ডাল, ফুল দিয়ে সাজিয়েছে সে মনের মতন। ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে বাবা নীল-গলা পাখি। গাছের নিচু ডালে দোল খেতে খেতে বলল, 'শুনছ গিন্নি- খবর ভালো না! আগামী বছর থেকে হয়তো এই জায়গার পাট তুলতে হবে আমাদের। একদল রঙিন গলা হাঁসের মধ্যে জোর তর্ক হচ্ছে শুনলাম। এই মস্ত বড় বিলটা ভর্তি হয়ে নাকি রাস্তাঘাট বাড়ি বানানো হবে! দুষ্টু লোকগুলো যাতায়াত করছে দুবেলা। কারা যেন রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি গর্তে হাত ঢুকিয়ে কাকড়া, কচ্ছপ ধরছে
ডিম আর বাচ্চাদেরও চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। সেদিন ঝিলের বাঁদিকে জঙ্গল থেকে কত কচ্ছপের মৃতদেহ পাওয়া গেছে জানো। আজ সবাই মিলে তাই মিটিং বসার কথা । বিকেলে ঝিলের মাঝে যে উঁচু মতন ফাঁকা জমিটা আছে, সেখানেই জোছনার আলোয় ন্যাড়া পাতা-ঝরা গাছটাতে বসবে সভা।'
সন্ধে হতেই চিরিক চিরিক করে দল বেঁধে বিলটাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে ওরা। বড় সুন্দর লাগে তখন এই ঝিলটাকে দেখতে। আশেপাশের দশ বারোটা গ্রামের মানুষ বেঁচে থাকে এই ঝিলটাকে ঘিরে। এই ঝিলের জলে হাজারো রকমের মাছ, জলজ প্রাণী, পাখি, সাপ, ব্যাঙ, ছোট ছোট পোকামাকড়,আর কত রকমের গাছপালা ― সকলে একসাথে বাস করে মিলেমিশে। ঝিলটা ভরাট হয়ে গেলে এ সবই তো নষ্ট হয়ে যাবে!
'কী আর করবে গিন্নি ভেবে ভেবে? একটা ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। বিলের ওই পূর্ব কোণে যে গ্রামগুলো আছে, সেখানকার মানুষজন জোর লড়াই করছে। ওরা তো খুব ভালোবাসে এই ঝিলটাকে। মাছ ধরে, জঙ্গলের কাঠ বেঁচে দিন কাটায়। একটা বাচ্চা ছেলেকে আমি রোজ দেখি , সব সময় আমাদের খোঁজ রাখে, যত্ন করে। কতদিন সকালবেলা এসে এই বিলের ধারে ধারে পাখিদের জন্য খাবার ছড়ায়। দেখনি তুমি ওকে? সমস্ত গ্রামের মানুষই আমাদের সাথে আছে গো। চিন্তা কোরো না।' উত্তেজিত গলায় কিচিরমিচির করে নীল-গলা।
কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে এল। জোছনা মাখা চাঁদের আলো, গলানো রুপো ঢেলে দিল সমস্ত ঝিলের জলে। মস্ত গোটা চাঁদটা যেন নেমে এলো ঝিলের জলের ভিতর সাঁতার কাটবে বলে। গাছের পাতায় পাতায় ঠিকরে পড়ল সে আলোর রোশনাই। প্যালিকেন, হক, হর্ণবিল সবাই মিলে জড়ো হল দ্বীপের মাঝে। সাদা গাছ গুলো ভরে গেল পাখির কলতানে। যেন কনসার্ট বসেছে। পাখিদের কিচিরমিচিরে কান পাতা দায় হয়ে পড়ল। হঠাৎ জোর গলায় চিৎকার করে এক ধমক দিল প্রবীন ক্রেন মহাশয়। তাঁর হেড়ে গলায় এইবার সব চুপ।
'বন্ধুগণ! আজ এক ঘোর বিপদের দিন উপস্থিত। কিছু দুষ্ট লোক আসা-যাওয়া শুরু করছে আমাদের এই ঝিলের ধারে ধারে। এই ঝিলে আর শান্তি নেই বন্ধুরা। সবাই মিলে আমাদের কিছু করতেই হবে। নয়তো আগামী বছর থেকে আর আমাদের দেখা হবে না। এ আমাদের বড় ভালোবাসার জায়গা বন্ধুরা। আমাদের পূর্ব পুরুষদের বাসস্থান।'
হঠাৎ দূরে বিলের যে পাশে নীল-গলা বউদের ছোট্ট বাড়ি সে দিক থেকে ভেসে এল একটা চিৎকার, হইচই। রাতের অন্ধকারের বুকে সাদা সাদা তারার মতন আলোর ঝলকানি আর দুড়ুম দুড়ুম শব্দে, মুহূর্তে কেঁপে উঠল আকাশ বাতাস। পাখিদের আর্ত চিৎকারে ভরে গেল জায়গাটা। নীল-গলা বউ ছুটে গেল বাসার দিকে।
হঠাৎ কিছু বোঝার আগেই একটা পাথর ছুটে এলো কোথা থেকে আর লাগল ছোট্ট পাখির ডানার নীচে। ঝাপটে পড়ে গেল ছোট্ট নীল-গলা বউ। ভিড়ের মধ্যে থেকে ছুটি এল একটা ছোট্ট ছেলে। এই ঝিলের প্রতিটা পাখি, প্রজাপতি, কাঁকড়া, কচ্ছপ ওর প্রাণের বন্ধু, আত্মার আত্মীয়। টর্চ লাইটের আলোয় ছেলেটা তুলে নিল নীল-গলা বউকে তার বুকের কাছে। ছোট্ট পাখির লাল চোখে ফুটে উঠল কৃতজ্ঞতা। সে যেন কাতর স্বরে বলতে চাইল ―
"মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।"
এর মধ্যেই ফরেস্ট অফিসার, পুলিশ আর পাঁচটা গ্রামের মানুষ ঘিরে ধরেছে ওই দুষ্টু লোকগুলোকে। চারিদিকে ফ্ল্যাশ বাল্বের আলো, অনেক রকম শব্দ, হুড়োহুড়ি। বনদপ্তর আর এলাকার মানুষ মিলে জোর কদমে চালাচ্ছে উদ্ধার কাজ। নীল-গলা বউ বুঝল তার ডানার তলায় গভীর ক্ষততে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বাচ্চা ছেলেটি। তার ছোট্ট ছোট্ট নরম হাতের ছোঁয়ায় সে বড় আরাম পেল। একটা ছোট্ট নরম তোয়ালে জড়িয়ে গরম বাক্সে শুয়ে দিল কারা যেন তাকে । তারপরে দ্রুত বেগে নিয়ে গেল ফরেস্ট ক্যাম্পে।
দূর থেকে গাছের ডালে বসে বাবা নীল-গলা জোরে জোরে ডেকে বলল ― 'চিন্তা নেই বউ। গ্রামের মানুষের ভালবাসার প্রতিদান দিতেই হবে আমাদের। সুস্থ হয়ে আমরা আবার ঘর বাঁধব এখানেই। বাচ্চাদের নিয়ে আমি অপেক্ষায় রইলাম।'
সুপর্ণা সেনগুপ্ত