Image-Description
Stories
পশুপ্রেমী
Mar 23 2023 Posted by : Admin

ফোনটা রেখে দিয়েই সোফায় ধপ্ করে বসে পড়ে ভাবতে শুরু করে মালিনী, এই সুদূর আমেদাবাদে বসে কসবার ছাদের ভাম সে কি করে তাড়াবে ভেবে পেল না।

ফোনে ভাই বাবাই এর বউ জয়তীর আকুতি এখনও কানে ভাসছে, “কিছু একটা কর দিদিভাই,কাল তারা সপরিবারে এসেছে।আমি পুজো করে পিছন ফিরেই দেখি বিশাল কালো চেহারা,চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে!! আর বাচ্চা দুটো তো জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ছে, টেবিলে ফল রেখেছিলাম পরশু খেয়ে গেছে।“

পিছন থেকে শোনা যাচ্ছে আট বছর বয়সী ছোট ভাইঝি লাজবন্তীর কচি গলার বায়না, “আমি কথা বলব পিসিমণির সঙ্গে,ফোন দাও।“

ফোন হাতে পেতেই মিষ্টি মিষ্টি গলায় তার আবদার, “ও পিসিমণি, ওরা ভাম নয় গো নিনি আর সিনি!আমি ওদের পেট বানাবো,মামমাম্ টা খুব ভীতু,আমি ওদের লিচু খাওয়াবো,তুমি বলে দাও ― যেন না তাড়ায়।“

মালিনী তখনই বুঝেছে সমস্যা বেশ গুরুতর,সবে ফোনে উপদেশ দিতে যাচ্ছিল ― ”একটু ঠ্যাঙানি দে,আর এমুখো হবে না।“

কিন্তু ছোটোভাইঝির কাছে ভাবমূর্তিটা কি দাঁড়াবে ভেবে চুপ করে গেল,ফোনটা এবার ভাই বাবাইয়ের হাতে —“দ্যাখ,দিদি,এই  জয়তীটা এত ভীতু,জানলা, দরজা, এই গরমে সব বন্ধ করে বসে আছে।তবে এগুলোও বড় বাড়াবাড়ি করছে,ফল খাবি খা,আমি ছাদে দিয়ে আসছি। কিন্তু শখের গাছগুলোও ভেঙে দিচ্ছে আর থ্যাঙ্কস্ দিতে পটিও করে দিয়ে যাচ্ছে।“

“আচ্ছা একটু সময় দে“ ― বলে ফোনটা কেটে থম্ মেরে বসে ভাবতে থাকে মালিনী।

পশুপ্রেমীরা, মালিনীর ধারণাতে তিন ধরণের ― 
১) জেনুইন পশুপ্রেমী, ২) ফ্যাশনেবল পশুপ্রেমী 
৩) চাপে পড়ে পশুপ্রমী।

মালিনী জানে সে তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত ― প্রথম শ্রেণীতে আছে তারই সহোদর বাবাই, ননদ চন্দনা,ননদা্‌ই রাণাদা,এক জেঠতুতো ভাসুর।এদের পশুপ্রেমটা যে কোন্ লেভেলের, বাইরে থেকে সাধারণ লোক মাপতেই পারবে না।

ননদ চন্দনা যেমন মালিনীকে গাড়ী চালানো শিখতে পুরানো গাড়ীর চাবি দিয়েই বলে দিয়েছিল, “মানুষকে ধাক্কা  মারলেও মারতে পারিস,কিন্তু একটা কুকুরেরও যেন না লাগে।“

ছোট থেকেই রাস্তা থেকে কাদামাখা কুকুর তুলে আনে। ননদাই ও রাম মিলায় জোড়ী,বর্তমানে গোটা পাঁচেক পুষ্যি তাদের,কে বর্ষায় ভিজছিল,কার মালিক মারা গেছে।

ভাসুর তো আরও এক লেভেল এগিয়ে! একবার বাড়ীতে একটা গাধা এনে হাজির,অ্যাক্সিডেন্টে পা ভেঙেছে ― যতক্ষণ না চলমান হল বাগানেই থাকল। রাস্তার কুকুরদের রোজ রাতে রুটি খাওয়ানো,গায়ের পোকা পরিস্কার,পিচুটি সাফ করা তো রোজকার রুটিন।

দ্বিতীয় ধরণের ফ্যাশনেবল পশুপ্রেমীরা কাগজে ফেসবুকে পশুদের উপর অত্যাচার নিয়ে এমন মমস্পর্শী লিখবেন, যে পড়ে চোখে জল এসে যাবে। চেনাজানার মধ্যেই আছে―বিয়ের আগে বড়লোক হবু বউমা ল্যাব্রাডর পাঠাল,সে ডগি ছাড়া থাকতেই পারে না,তার জন্মদিনে (ডগির)কেক কাটা, ফটো আপলোড—তারপর জানা গেল কুকুর ফেলে বিদেশ যাত্রা। আগে কেরিয়ার পরে সারমেয় প্রীতি,চাইলে ওদেশে একটা হাস্কি যোগাড় করে নেওয়া যাবে ― কারণ ডগি সহ ফটো না দিলে তো আর ফেসবুকে সেই স্ট্যাটাস থাকবেনা।

কিন্তু এই তৃতীয় শ্রেণীরাই মানে মালিনীর মতো যারা চাপে পড়ে পশুপ্রেমী, তাদের ই কপালে চরম ভোগান্তি থাকে।

বাবাইয়ের মতো জেনুইন পশুপ্রেমীর দিদি হওয়ায় কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি তাকে। মালিনীর বিয়ের দিন দশেক আগেই কলেজ থেকে উদভ্রান্তের মত বাড়ী ঢুকল বাবাই। সঙ্গে রক্তাক্ত কুকুর ছানা, চোয়াল ঝুলছে।মায়ের আইবুড়ো বেলায় কুকুর ছিল, মা-ও ফিল্ডে নেমে পড়ল।

গরম জলে পরিস্কার করে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল,সকালে বাবাই গেল কলেজ, বাবা
অফিস। একটু বেলায় ওষুধের ঘোর কাটতেই শুরু হল যন্ত্রনাকাতর চিৎকার! মা তখন অসহায় ভাবে মালিনীর দিকে তাকিয়ে।অগত্যা থলিতে তাকে ভরে ট্রেনে চেপে গড়িয়া থেকে শিয়ালদহ ছুটল মালিনী।

ছোটো বাচ্ছা তাই থলে থেকে মুখ বেরোচ্ছে না,খালি হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করছে। ভাবী ননদ চন্দনা ও  অফিসের কাজ মাঝপথে কাজ ফেলে হাজির ― একঘন্টা চলল অপারেশন ভেটেরিনারী হসপিটালে।

এরপরই আসল খেল ― পুরো শরীরটা লম্বা হয়ে গেছে, ঘুমন্ত আর থলিতে নেওয়া যাবে না। মালিনী  নিরুপায় হয়ে গড়িয়া মিনিতে পিছনের সীটে কোলে কুকুর নিয়ে বসে গেল, বেশি ভাড়া দেবে বলেই দিয়েছিল কন্ডাক্টারকে। এখনও মনে পড়ে দু একজন যাত্রী এভাবে ওঠা ঠিক নয় বলার চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু এমন  একটা মুখ করে মালিনী তাকিয়েছিল পারলে ভষ্ম করে দেয়, শান্ত স্বরে বলেছিল ― “অবলা প্রাণীগুলোর খেয়াল আমরা না রাখলে কে রাখবে?” যদিও সে চাপে পড়া পশুপ্রেমী,কিন্তু ঘাড়ে দায়িত্ব এলে ফেলতে পারে না, মনে মনে বাবাইয়ের মুন্ডপাত করতে করতে বাড়ী ফিরেছিল সেদিন।

এরপরেও অসংখ্য ঘটনা আছে বাবাইয়ের পশুপ্রীতির ― কখন ও ইলেক্ট্রিক তারে সুতোয় পা জড়িয়ে যাওয়া শালিক বাঁচাচ্ছে,নয়ত অন্ধ কুকুরকে রোজ খাওয়াচ্ছে।রাস্তায় বেরোলেই প্রভুর পিছু পিছু একপাল বিশ্বস্ত সারমেয় কুল। গত বছরই মালিনী আর বাবাই বিড়লা অ্যাকাডেমীতে বিশাল এক্সহিবিশান করল,ঠিক উদ্বোধনের আগে,সেলিব্রেটীরা হাজির,দু তিনটে মিডিয়া হাউস কভার করছে, বাবাই নিপাত্তা। ফোন করতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় বাবাই জানাল —“বিড়লার পাশের গলিতেই দেখি কিছু বাচ্ছা বুঝতে পারছে না কী করবে! একটা ইনজিওরড, বাজ পড়ে আছে, তাই ভেট-এর কাছে এখন।“

বোঝো ঠ্যালা,তা এহেন বাবাইয়ের বউ জয়তীর কুকুর,বেড়াল সবেতেই বিশাল ভীতি, এবার তো ভাম তাও সপরিবারে।

অগতির গতি ননদ চন্দনাকেই ফোনটা লাগাল মালিনী,বনদপ্তরে অনেক চেনাশোনা তার, যোগাড় হল ফোন নম্বর। তারা এসে বড় খাঁচা পেতে দিয়ে গেল।

কিন্তু হায়!! অভিনব উপায়ে, রাতে এসে সপরিবারে খাঁচায় রাখা রুটি কলা সহযোগে ডিনার সেরে গেল। আবার ফোন বনদপ্তরে ,তাদের বক্তব্য খাঁচাতো ভারী কিছু ঢুকলেই দরজা বন্ধ হবে।

মনে হয় সব কাজে যেটি না হলে চলে না, এখানেও সেটিরই অভাব ঘটছে ― তেল। অতএব লকডাউনে বাড়ী বসে খাঁচার দরজায় তেল দিল বাবাই।

মালিনীকে ফোন করে ক্লাস টেনে পড়া বড় ভাইঝি মধুমন্তী  জানাল,"পিসিমণি ২০২০-র ভাম, ডিজিটাল দুনিয়ার ভাম ― সহজে ধরা পড়বে না দেখো।"

এদিকে দুবেলা চন্দনাও খবর রাখছে; পড়ল ধরা দুদিন পরে মা ভামটি।

বাবাই তো ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল, প্রায় জামাই ষষ্ঠীর মতো ফল এনে খেতে দিচ্ছে,প্লাস্টিক পাউচ ফুটো করে জল খাওয়াচ্ছে, পাছে রোদ লাগে খাঁচা ঢেকে দিচ্ছে।

কিন্তু ছোট ভাইঝির একটাই প্রশ্ন ফোনে মালিনীকে, ”নিনি,সিনি কোথায় গেল পিসিমনি? মাকে ছেড়ে কি করে থাকবে ওরা?” যদিও মালিনী চাপে পড়ে পশুপ্রেমী কিন্তু মা ধরা পড়ল বাচ্ছাগুলোর কি হবে ভেবে সারারাত ঘুমোতে পারল না। এরপরেও আবার  বনদপ্তরের লোক ছোট খাঁচা পেতে গেছে কিন্তু বাচ্ছা ধরা পড়ছে না।

জয়তীরও মনটা খারাপ ― এভাবে মা, বাচ্চা কেউই আলাদা করতে চায় না।

জয়তী পরদিন সকালে হঠাৎই  কুঁইকুঁই আওয়াজ শোনে জুতো রাখা বক্সের নীচে থেকে। আবার মালিনী কে ফোন, ”কী করব দিদিভাই?”

এবার খাঁচা পাতা হল জুতোর বক্সের সামনে ফল জল ভর্তি, কালো চাদরে ঢাকা ― খাঁচায় আস্তে আস্তে বাচ্ছারা ঢুকে গেল ।

দিব্যি খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়েও পড়ল।পরের দিনই ধরা পড়ায় মায়ের কাছেই পৌঁছেছে ― এটাই আশার কথা।

তবে মালিনী আজও ভেবে পায় না যদিও সে চাপে পড়ে পশুপ্রেমী তবুও এদের নিয়ে এত উতলা কি করে হয়ে যায়!

লেখক : মল্লিকা ব্যানার্জী
 


Popular Books


Comments

  • মালবিকা মল্লিক

    খুব সুন্দর গল্প????????। শিশু সাহিত্য, ছোটদের গল্প এখন আর পাওয়াই যায় না। কলম চলুক। পরবর্তী গল্পের অপেক্ষায়।

    Mar 24 2023
  • piFhzauftwEcD

    Sep 27 2024
  • FGQIENxbDlORY

    Nov 10 2024
  • FGQIENxbDlORY

    Nov 10 2024

Write a Comment