পঙ্কজ এবার স্কুলে ভর্তি হবে। এই আড়াই বছর বয়স হয়ে গেল তো। ও খুব মিষ্টি ছেলে জানো! বাবা যা শেখাচ্ছেন সব শিখে নিচ্ছে। এ বি সি ডি, এক দুই তিন চার, ছড়া, সব।সব। মা-বাবা শহরের সব থেকে ভালো স্কুলে ওকে ভর্তি করতে চান। বাবা বলেন ―
"লক্ষ্মী ছেলে এমন পেলে
লুফে নেবে এমন ভেবে
নামটি তার পঙ্কজ,
নেইকো জুড়ি ভুরিভুরি
মনে যে তার নেই কোনো ক্ষার
নেই কোনো সঙ্কোচ!"
পঙ্কজ গড়গড় করে মুখস্থ বলে দেয়। আধো আধো উচ্চারণে কী যে মিষ্টি লাগে না!
একদম ছোটোবেলায় মা ওকে বলতেন,
"আমার সোনা,চাঁদের কণা!"
বাবা বলতেন,
"আমার বাপি গাড়ি চাপি
স্কুলেতে যাবে!
বই পড়িবে সকল জীবে
দয়া দেখাবে!"
ও কী বুঝত ভগবান জানেন! বাবা যখন এগুলো বলতেন, তখন ও বাবার চোখের দিকে চেয়ে উম উম করে এমনভাবে একখানা ফোকলা দাঁতি হাসি দিত যেন সব বুঝে গেছে!
দিদুন বলতেন ―
"এমন ছেলে কাছে পেলে
ঠিক করিতাম আদর
হোকনা বেশি শীতের দেশই
হোক না ভরা ভাদর!"
দিদুন তো অনেক দূরে থাকেন।সেই চন্দননগর! তাই মাঝে মাঝেই ভিডিও কল করতেন! ওই পুচকু বেলাতেই ও বুঝে ফেলত সব।মোবাইলের ভিতরই দিদুনকে দেখত। হাত বাড়িয়ে ধরতে যেত। আর দিদুন ছড়া বললেই হেসে কুটিকুটি হয়ে যেত!
আরো একটু বড় হলে আরো অনেক কথাই বলতো।তখন মোটামুটি হাঁটতে শিখেছে।মোবাইল কানে চেপে ধরে অনর্গল কথা বলে যেত। মাঝে মাঝে আবার তর্জনী উঁচিয়েও বকার ভঙ্গিমায় কত কিছু যে বলত! কিন্তু হায়! সবই ওর নিজস্ব ভাষায়! একটা শব্দও যদি অর্থপূর্ণ হত!
"হাসে বাবা হাসে কাকা
পাড়া প্রতিবেশী।
ফোকলাদাঁতি কারো নাতি
খুশির নেই কো শেষই।"
আজ তার এডমিশন টেস্ট।সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! এত্ত বড়ো নাম করা স্কুলে চান্স পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
যা যা শেখানোর কথা সব সে জানে।ভআনন্দে দৌড়ে দৌড়ে সে নিজেই নিজের জামা এনে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছে।অর্থাৎ পরিয়ে দাও। জুতোটা নিজেই পরার চেষ্টা করেছে।কী স্ফূর্তি ওর! আসলে ওতো জানেই না যে ও ইণ্টারভিউ দিতে যাচ্ছে! পুচকি বেলা থেকেই ও মা-বাবার সাথে ঘুরতে যেতে পছন্দ করত,আজও তেমনই কিছু ভেবেছে।
নির্দিষ্ট সময়ে ওকে ওর মা-বাবার সঙ্গে ইণ্টারভিউ রুমে নেওয়া হল।
প্রথমেই মিস জিজ্ঞাসা করলেন, "তোমার নাম কী??"
একটু থমকে গেল সে।তারপর বলল, "চোনা!"
মিসের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল! তিনি বললেন, "আবার বলো দেখি।শুনি। নাম কী তোমার?"
পঙ্কজ বলল, "চোনা!"
এখন পঙ্কজের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে সোনা আর চোনা এক জিনিস নয়।অবশ্যই সে জানে যে সে "সোনা"-ই বলছে। কিন্তু মিস যখন দ্বিতীয় বারও নামটাই আবার জিজ্ঞাসা করলেন তখন ও একটু থমকে গেল।সবার মুখের দিকে চাইতে লাগল।
"বলছে চোনা আসল সোনা
না জানে তার মানে!
নরম শিশু! সাক্ষাৎ যীশু!!
তাকায় সবার পানে!"
এবার ও মনে মনে ভাবতে আরম্ভ করল। ওকে কে কী নামে ডাকে। ওর মনে পড়ল ওর মাসি ওকে কোলে তুলে খুব আদর করেন আর বলেন-
"যাদুমণি সোনার খনি
আমার প্রাণের ধন!
কাছে এসো ভালোবেসো
জুড়ায় আমার মন!"
মনে পড়ে যেতেই পঙ্কজ কলকল করে বলে উঠল, "চোনার!"
মিস জিজ্ঞেস করলেন,
" কে তোমাকে চোনা বলে ডাকেন?"
পঙ্কজ বলে, "চোনা না চোনা না। আমি চোনা!"
মিস এবার বুঝলেন যে শিশুর উচ্চারণে সমস্যা আছে।মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। ওঁরা বুঝে গেছেন এই ছেলেকে ভর্তি নেবেন না।
বাবার তখন রাগে গা জ্বালা করছে। এত করে বলে দেওয়া হয়েছে যে তোমার নাম পঙ্কজ।বারবার বারবার বারবার করে বলে দেওয়া হয়েছে। এখন এখানে এসে সব চোনা!?
"পঙ্কজ মানে কেউ কি জানে?
জানলে বলো হাতটি তোলো।
না জেনে হায় পদ্ম ফুলকে,
মরো না আর মাথা চুলকে!"
এমন কী এই ছড়াটাও তার মুখস্থ! আর এখন এখানে এসে সব চোনা আর চোনার!! উফফফফ! দুশ্চিন্তা করতে করতে বাবার মুখ থেকে বিরক্তিসূচক উফফফ শব্দ বেরিয়ে গেছে!
পঙ্কজ যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সে ওমনি বাবার মুখের দিকে তাকিয়েছে। সে ঠিক বুঝতে পেরেছে যে বাবা রাগ করেছেন। সে কি কিছু ভুল করেছে?? ভেবে বাবার মুখের দিকে চেয়েই পঙ্কজ গড়গড় করে ছড়াটা বলে গেল। এক বিন্দুও বাধল না কোথাও। উচ্চারণও স্পষ্ট।বাবার মুখে হাসি ফুটল। মিসও হাসলেন।তারপর বললেন, "আর একবার শুনি!'
পঙ্কজ আবার ছড়াটা বলল! মিস বললেন, "তাহলে নাম কী তোমার??"
পঙ্কজ গম্ভীরমুখে বলল "পচা!"
অথচ ছড়াটা বলার সময় সে স্পষ্ট পঙ্কজ নামটাই উচ্চারণ করেছে!
পঙ্কজের উপর বাবা খুব রেগে গেলেন।এই ছেলেকে এত ভালো স্কুলে আনাটাই ভুল হয়েছে!
পঙ্কজের বাবা উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে।
মিস বল্লেন--"যাচ্ছেন কোথায় পচার ভালো বাবা?? মিষ্টি আনতে?? তা যান কিন্তু পঙ্কজকে এখানে ভর্তি করতে আরো একদিন আসতে হবে তো। আগামী মাসের এক তারিখেই ভর্তি শুরু হবে।আসুন তারপর যে কোনোদিন।"
সব্বাই হো হো হেসে উঠলেন।
মিস বললেন, "আমি তো ওর মুখে খালি ছড়াই শুনব। আর সমস্ত পড়াই ছড়ায় ছড়ায় ছড়িয়ে দেব!"
লেখক : সপ্তদ্বীপা অধিকারী