স্কুল থেকে ফিরে রুকু যখন বলল, “মা জানো আজ স্কুলে আমার একটা বন্ধু হয়েছে!” তখন ওর মা খুব খুশি হলেন। গত প্রায় এক মাস ধরে ‘বন্ধু নেই, বন্ধু নেই’ করে মাথা খেয়ে ফেলছিল রুকু। নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ঐ ‘আমার কোন বন্ধু নেই, আমার কোন বন্ধু নেই’ রব। কলকাতার স্কুলে ওর প্রচুর বন্ধু ছিল, সেই কোন ছোটবেলা থেকে ওই স্কুলে পড়ছিল বলে; আর এখন বাবার কাজের সূত্রে মার্কিন মুলুকে এসে যত বিপদ! নতুন জায়গা, নতুন স্কুল ― সব কিছুই নতুন। রুকু এমনিতে সামলে নিয়েছে কিন্তু স্কুলে বন্ধু না থাকাটা বেশ কষ্টের। তাই মা-বাবাও ওকে নিয়ে বেশ টেনশনে ছিলেন।
তাই বন্ধু হয়েছে শুনে মা বললেন, “বাহ! এ তো খুব ভালো খবর! তা কী নাম তার?”
“ওর নাম কুপার। ও না কাছেই থাকে। একটু পরেই আসবে, তখন তুমি ওকে দেখতে পাবে।”
মা প্রথমে বিশ্বাস করছিলেন না কিন্তু একটু পরেই কুপার এসে হাজির হল। খুব রোগা হাড়গিলে চেহারা তার, চোখে মোটা চশমা। তবে ছেলেটা এমনিতে খুব ভালো। এক গাল হেসে মাকে ‘হাই, হাউ আর ইউ?’ বলল। কম্পিউটারে দারুণ ভালো সে। অঙ্কেও খুব ভালো। তবে ওর সঙ্গে রুকুর চেহারার একেবারেই মিল নেই। রুকুর চেহারা বেশ ভালো তাই কুপার বাড়ি চলে যেতে মা বললেন, “বেশ লরেল-হার্ডি, হাঁদা-ভোঁদার জুটি হয়েছে তোদের দুজনের!”
রুকু সেটা শুনে হি হি করে হাসল।
এরপর থেকে কুপার প্রায়ই আসে ওদের বাড়িতে। মা যা খেতে দেন তাই দিব্যি খায়। রুকুও যায় ওদের বাড়িতে। কুপারের মা-ও ওকে নানা রকম কেক, কুকি, পাই-টাই খেতে দেন। ভীষণ মিষ্টি খেতে ভালোবাসে কুপার, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল ওর গায়ে কিছুই লাগে না, রোগা তো রোগাই!
কয়েকদিন পর রুকু স্কুল থেকে ফিরে এসে চুপ করে আছে দেখে মা বললেন, “কী ব্যাপার? আজ এত চুপচাপ? কিছু হয়েছে নাকি স্কুলে?”
রুকু শুকনো মুখ করে বলল, “আজ পিটি স্যার বলেছেন আমরা কয়েকজন পিটিতে ফেল করব!”
“অ্যাঁ! সে কি! কেন? আমরা মানে কারা?”
“আমি, কুপার আর আরো তিনটে ছেলে, এই পাঁচজন!”
“ওমা কী হবে তাহলে? পাশ করার কী কোন উপায় নেই?”
“স্যার বলেছেন আমাদের সবার মার্ক্স খুব খারাপ তাই আমাদের পক্ষে পাশ করার একমাত্র উপায় হল পরের সপ্তা'র দুশো মিটার দৌড়টাতে দৌড়ে ওটাকে শেষ করা! আমরা তো বলে দিয়েছিলাম দৌড়ব না কিন্তু এখন তো দেখছি না দৌড়ে উপায় নেই মোটেই!”
রুকুর ওই এক সমস্যা। পড়াশোনাতে সে মন্দ নয় কিন্তু খেলাধুলো মোটেই করতে চায় না। পিটিতে কলকাতায় থাকতেও কোন রকমে কষ্ট করে পাশ করত আর এখানে তো ওই সবের ওপর ভালোই জোর দেয়। এমনিতেই সে খেলাধুলোয় অপটু তারপর একটা বন্ধুও এমন জুটেছে যে সেও খেলাধুলো মোটেই করতে ভালোবাসে না।
রুকু আবার বলল, “ফেল করলে খুব বাজে ব্যাপার হবে, তাই না? অন্য সব সাবজেক্টে এ আর পিটিতে এফ! সেই জন্যে আমি আর কুপার ঠিক করেছি যে রোজ বিকেলে দৌড়ব একটু করে! অন্তত দুশো মিটারের দৌড়টাকে শেষ তো করতে হবে!”
মা আর কী বলবেন, বললেন, “হ্যাঁ, সত্যিই তো, পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলো করাও তো দরকার শরীরটাকে ভালো রাখার জন্যে!”
এরপর কয়েকদিন রুকু আর কুপার দুজনে মিলে দৌড়ের জন্যে প্র্যাকটিস করতে লাগল। খুব একটা ভালো সময় না করতে পারলেও দুজনেই দৌড়টা শেষ করতে পারছিল।
শুক্রবার দিন, মানে যেদিন দৌড়টা ছিল সেদিন বিকেলে ওদের একটা জন্মদিনের নিমন্ত্রণ ছিল। রুকু স্কুল থেকে ফিরতেই মা জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে তোদের দৌড় হল? পাশ করেছিস তো?”
রুকু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “হ্যাঁ!”
মা বললেন, “তুই আর কুপার দুজনেই পাশ করতে পেরেছিস তো?”
“হ্যাঁ!” বলে রুকু আরো কী একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় মার ফোনটা বেজে উঠল। মা ফোনে কথা বলতে লাগলেন। ফোনের কথা শেষ হতে না হতেই অরিন্দমকাকু চলে এলেন রুকু আর ওর মাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। অরিন্দমকাকু আর শ্যামাকাকিমার মেয়ে জিনির পাঁচ বছরের জন্মদিন। মা কাকিমাকে সাহায্য করবেন বলে ওদের তাড়াতাড়ি যেতে হল। বাবা পরে অফিস শেষ করে সোজা ওখানেই চলে যাবেন সেটাই কথা ছিল।
রুকু বেলুন ফুলিয়ে দিচ্ছিল আর কাকুকে ঘরটা সাজাতে সাহায্য করছিল। মা আর কাকিমা মিলে টেবিলে বসে শিঙ্গাড়াতে পুর ভরছিলেন। ঘরের টিভিটা এমনিই চলছিল গ্যাঁ গ্যাঁ করে। লোকাল নিউজ দেখাচ্ছিল সেটাতে। জিনি হঠাৎ আঙ্গুল দিয়ে টিভিটার দিকে দেখিয়ে বলল, “দাদা!”
মা টিভির দিকে তাকিয়ে দেখলেন স্কুলের দৌড় নিয়ে কী একটা বলছিল। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই ওরা অন্য খবরে চলে গেল।
তখন মা রুকুকে ডেকে বললেন, “হ্যাঁরে রুকু, তোদের ওই দৌড় নিয়ে কী একটা বলল মনে হল খবরে, কিছু হয়েছিল নাকি?”
রুকু তো প্রথমে কাকু-কাকিমার সামনে কিছুতেই বলতে চাইছিল না তারপর মা পীড়াপীড়ি করতে বলল, “দৌড়টা ঠিকঠাকই চলছিল প্রথম দিকে। প্রায় ১৭৫ মিটার মতন দৌড়বার পর কুপার হঠাৎ হোঁচট খেয়ে দুম করে পড়ে গেল, আর উঠতে পারছিল না! ওর পা-টা মনে হয় খুব জোর মুচকে বা ভেঙে গিয়েছিল। আমি তখন দেখলাম যে ও তো আর দৌড়টা শেষ করতে পারবে না আর তাহলে তো স্যার ওকে ফেল করে দেবেন। আমি তাই ছুটে গিয়ে ওকে তুলে নিয়ে বাকি দৌড়টা শেষ করলাম। পিটি স্যার অবশ্য তাতে মোটেই খুশি হননি, বললেন দৌড়বার সময় অন্য যারা দৌড়াচ্ছে তাদের ছোঁওয়ার নিয়ম নেই, তাহলে ডিসকোয়ালিফাইড হয়ে যায়! তাই আমাকে আর কুপারকেও ডিসকোয়ালিফাইড করে দিলেন! কিন্তু অন্য কয়েকজন টিচার যারা দেখছিলেন তারা প্রিন্সিপালকে গিয়ে বলে দিতে উনি স্যারের ওপর রেগে গিয়ে বললেন, ‘যে কোন খেলা বা স্পোর্টসের প্রধান শিক্ষা হল স্পোর্টসম্যানশিপ এবং সেটার নাকি চরম নিদর্শন এটা! ওদের ফেল করানোর কোন মানেই হয় না!’ তাই আমাদের পাশ করাতেই হয়েছে স্যারকে! এখন দেখছি কারা যেন আমি কুপারকে কাঁধে নিয়ে দৌড়চ্ছি সেটাকে ফোনে রেকর্ড করেছিল, সেটাই টিভিতে দেখাচ্ছে!”
মায়েরা সবাই তো রুকুর কথা শুনে কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না!
শেষে অরিন্দমকাকু বললেন, “রুকু তুই তো হিরো হয়ে গেলি রে!”
রুকু হেসে বলল, “ধ্যাৎ! হিরো হতে যাবো কেন, আমি তো বন্ধুর জন্যে যা করা উচিত সেটাই করেছি। ও দৌড়টা শেষ না করলে পিটি স্যার তো ওকে ফেল করিয়ে দিতেন! ভাগ্যিস কুপারটা রোগা পটকা তাই আমার ওকে তুলে নিয়ে যেতে কোন অসুবিধাই হয়নি!”
লেখিকা : অনন্যা দাশ
Blog
Stories
দৌড়
Aug 31 2023
Posted by : অনন্যা দাশ