জানালার গরাদে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রুশা। পড়ন্ত দুপুরের নিস্তেজ সূর্যালোক, আকাশী বুটির তাঁতের শাড়ির কুচির পাড় বেয়ে মেঝেতে মিশে গেছে। রুশার কাছে এই একটিই শাড়ি ছিল ওর মায়ের। চুলে বিলি কাটতে কাটতে বাইরের সবুজে মনকে এলিয়ে দিয়ে গুনগুন করে গান ধরেছে -"কেটেছে একেলা বিরহের বেলা---"
ছোট্ট একখান ঘর। পাশে একটি বাথরুম। ঘরের কোণেই রান্নার ব্যবস্থা। সদর দরজার ঠিক উল্টো দিকে একটা ছোট ব্যালকনি। জলের ব্যবস্থা রাস্তার কলপাড়। রোজ সকাল বিকেল দুই বালতি জল আর দুই লিটার খাওয়ার জলের বোতল ভর্তি করে আনলেই, বেশ চলে যায়। অতিথি আপ্যায়ন বলে কোন কিছু নেই। এই ভালোবাসার ছোট্ট গৃহ, সকলের অবারিত দ্বার।
রুশা বাড়ি ত্যাগ করেছে আজ ছ'বছর হল। ত্যাগ বলতে বিয়ের চাপে পালিয়ে আসা বলা যেতেই পারে। ছেলের বাড়ির কাছে প্রায় প্রত্যেকদিনই ,"পিছন সামন, বাঁয়ে ডাইনে, চাই নে চাই নে, বোসন, ওঠন, ছড়ান গুটন, উল্টো পাল্টা ঘূর্ণি চালটা-"
আর তারপর, তারপরই আত্মীয়দের উক্তি, ' ঘরে বসে বসে মুটোচ্ছে, গতরখানাই পেয়েছিস, রূপ তো নয়, গুয়ের মালসা...", কেউ বলত,' ছ্যা ছ্যা কালো কুৎসিত ঢোল গোবিন্দ আবার নামখানা দেখো রুশা...।' মায়ের দেওয়া আদর জড়ানো নামটা যেন অভিশপ্ত হয়ে উঠছিল দিন দিন। মামা মামীর সংসারে রুশা তখন উটকো ঝামেলা। মা যখন ছেড়ে চলে গেলেন, তখন রুশা উঠতি তরুণী, ক্লাস ইলেভেন। জন্মের পর থেকে বাবাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। আত্মীয়তায় ফেলে দিতে পারেন নি মামা, মা মরা তরুণীকে। মামা বাড়িতে থেকেই টিউশন পড়িয়ে সত্তর শতাংশ নম্বর পেয়ে গ্ৰ্যাজুয়েশন করেছিল সে। টিউশনের টাকা থেকে খাই খরচা হিসাবে একটা অংশ তুলেও দিত মামীর হাতে, প্রতি মাসে। যতই হোক স্বীয় দায়বদ্ধতা তো থেকেই যায়। একদিকে পড়ার অদম্য ইচ্ছে, অন্যদিকে বিয়ের চাপে, তিতি বিরক্ত হতে হতে একদিন সাঁঝের অন্ধকারে বেরিয়ে এসেছিল রুশা। নাহ, কেউ খোঁজ করেনি তার। শান্তিপ্রিয় রুশা ঠকায়নি কাউকেই, শুধু আসার সময় মায়ের ছবিটা সাথে নিয়ে এককাপড়ে বেরিয়ে এসেছিল সে। অনেক ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে আজ সে শিমূলতলার প্রাইমারী স্কুলের দিদিমণি।
শিমূলতলায় তখনও বিদ্যুতের লাইন হয়নি, মোবাইল প্রযুক্তি তো অনেকদূর। আদিবাসী অধ্যুষিত শিমূলতলায় বেশীরভাগই সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডা। দু'একটা ক্ষমতা সম্পন্ন বাড়ি ছিল। এখানে এসে রুশা প্রথমে একটা মাটির চালার ঘরে থাকত। কুয়ো থেকে জল তুলে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসত। রোজ সকালে গোবরজলে নিকিয়ে দিত পাশের প্রভাবশালী বিহারী কাকীর উঠোন। সোরেন, মুর্মুরা এসে ওকে দুমুঠো চাল আর মটরশাক দিয়ে যেত। তাই ভাতে ভাত ফুটিয়ে দিব্বি একবেলা চলে যেত। সকালের রেখে দেওয়া ভাতের ফ্যান ফুটিয়ে রাতের বেলা হয়ে যেত। আর যেদিন বিহারীকাকীর আত্মীয়-স্বজন আসত, সন্ধ্যে থেকে ডাক পড়ত রুশার। ও যে খুব ভালো গান জানে। সকলকে মাতিয়ে রাখাই ছিল তখন ওর সন্ধ্যার আসর। সেদিন অবশ্য রুশার কপালে মাংসের ঝোল আলু আর একমুঠো ভাত জুটত, সেটাই যেন অমৃত। আশ্চর্যের ব্যাপার হল সবশেষে যখন খেতে বসত, বিহারীকাকী ওকে টেবিলে থালা সাজিয়ে দিত আর নিজেও ওই একই আলু ঝোল ভাত আর একটা পেঁয়াজের টুকরো নিয়ে ওর পাশে বসে গল্প করতে করতে খেত। এক এক দিন রুশা কাকীকে জড়িয়ে ধরে বলত, 'কাকী এ স্বাদের ভাগ হবে না, তাইতো তুমি কাকী আবার মাও, মানে বাংলায় আমরা বলি কাকীমা।' বিহারী কাকীও ওকে বুকে টেনে নিত। অদ্ভুত মমতাময় সে হৃদ্যতা।
একদিন সকালে রুশা যখন কলপাড়ে জলের লাইনে, দেখে মুর্মুদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পুরোনো কাগজকে প্লেন বানিয়ে খেলছে। কেউ বা পাখা, আর কেউ, কেউ পদ্মফুল। রুশার ঠোঁটে আনন্দের রেখা ফুটে ওঠে। তাড়াতাড়ি জল এনে, যত হিজিবিজি কাগজ ছিল, নিয়ে বসে পড়ে বিভিন্ন ওরিগ্যামি বানাতে। এভাবে বিভিন্ন জন্তু, ফুল, গাছ, বাড়ি, রকেট কত কী বানাতে থাকে রুশা! আর প্রত্যেকদিন মুর্মু, সোরেনদের বাচ্চাগুলোকে এক একটি দিয়ে বলে, সেটা সম্বন্ধে পাঁচ লাইন করে সকলে বলবে। একটা শোর পড়ে যায় বাচ্চামহলে। প্রত্যেক দিন নতুন কিছু জানার তাগিদে, তাদের উৎসাহ ও আনন্দ দুটোই বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে রুশা হয়ে ওঠে ওদের দিদিমণি। পাতার ছাউনি আর মাটির দেওয়ালে ছোট্ট একখান স্কুলঘর বানায় সকলে মিলে। পাশের ফাঁকা জমিতে অল্প চাষাবাদ। একে একে গ্ৰামের সব বাচ্চারা তিলে তিলে জড়ো হয়েছে। স্কুল বাড়ির পাশের জমিতে যা ফলন হয় তাই দিয়েই রান্না হয় রোজ। ওরা সকলে মিলে একসাথে বসে খায়, বাসন মাঝে, পরিস্কার করে আশপাশ। দিন শেষে বাড়ি যাওয়ার আগে একে একে রুশাকে জানিয়ে চলে যায়। কখনো কখনো শহরে গেলে ওদের জন্য ফল, সন্দেশ মিষ্টি, চকোলেট নিয়ে আসে রুশা। কী যে খুশী হয় ছোটরা! এখন ওরাই রুশার জীবন। আর ওদের কাছে রুশা একান্ত আপন। এর চেয়ে বড় স্বজন আর কিই বা হতে পারে! অদ্ভুত এক আত্মীয়তার সংযোগ। রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশী দামী এ সংস্রব।
আজ স্কুলের প্রথম বর্ষযাপন। নাচ,গান,কবিতা, আঁকা, হাতের কাজ, ছোট করে নৃত্যনাট্য সবেরই আয়োজন করেছে ছাত্রছাত্রীরা। মাটির প্রদীপ আর ফুলমালা দিয়ে সাজিয়েছে স্কুলবাড়ি।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওরা রুশাকে ডাকতে এল। দরজার আংটায় টকটক আওয়াজ হতেই, ভিতর থেকে সুরেলা কন্ঠ ভেসে এল, 'তোরা যা, আসছি আমি।'
জানালার কপাট দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো রুশা। কুচিটা একটু ঠিক করে নিয়ে, কপালের মাঝে ছোট্ট কালো একটা টিপ পরে, খোঁপাটা জড়িয়ে বেরিয়ে এলো রুশা। ছাত্রছাত্রীরা অবাকপানে তাকিয়ে। কি স্নিগ্ধ, নির্মল, সুন্দর দেখাচ্ছিল তাদের দিদিমণি কে। ওর হাত ধরে সকলে যখন স্কুলবাড়ির সামনে এল, রুশা দেখল, ফাঁকা জায়গাটায় একটা বড় করে আলপনা আর তার মাঝে লেখা 'মা'।
আপনা হতেই চোখের কোণটা ভিজে এল। ঠোঁটটা হাল্কা কেঁপে উঠল। বুকটা একটু মোচড় দিল। ঢোঁক গিলে, দুবার চোখের পাতার এপিঠ ওপিঠ হয়ে দম নিয়ে সোজা হয়ে একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ালো রুশা। আর ঠিক সাথে সাথেই ছাত্রছাত্রীরা গেয়ে উঠল-
' উঙ্গলি পাকড়কে চলনা শিখায়া,
হর কোই ডাঁটা, তুনে হাসায়া।
কেয়া গলৎ, কেয়া সহি,
জানতি না হাম।
হর কদম তুনে রাখনা শিখায়া,
হাথো সে তুনে হামকো খিলায়া,
মা - - - মা - - - ও- - - মা- - -
ইয়ে রিস্তে হ্যায় জনম জনম কী,
হামে ছোড়কে কভি না যা- -।"
শর্মিষ্ঠা চ্যাটার্জী