‘একটা গোয়েন্দা গল্প তোমাকে বলতেই হবে দ্বিজুমামা—। নইলে তোমাকে আমরা ছাড়ছি না।’ পিন্টুর কথায় সমর্থন জানিয়ে বিল্টু, টিঙ্কু, মিতা, রীতা সকলে মিলে চেপে ধরল দ্বিজুমামাকে।
পিন্টু-বিল্টুদের দ্বিজুমামা, দ্বিজেন মুখার্জী। চাকরি করেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে। মাত্র কয়েক বছরের চাকরিতেই বেশ নামডাক হয়ে উঠেছে তাঁর।
সেই দ্বিজুমামাই কয়েকদিনের ছুটি কাটাতে বেড়াতে এসেছেন পিন্টুদের বাড়ি দুর্গাপুরে। এসেছেন দুপুরের দিকে। পিন্টু, বিল্টু দু’জনেই তখন স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে দ্বিজুমামাকে দেখে আনন্দে বাড়ি মাথায় করে তুলেছিল তারা। আর তখন থেকেই মেতে উঠেছিল দ্বিজুমামাকে ঘিরে।
খবর পেয়ে বিকালে পাশের বাড়ি থেকে ছুটে এসেছিল টিঙ্কু, মিতা, রীতা। দ্বিজুমামার কথা অনেক শুনেছে তারা পিন্টু-বিল্টুর মুখে। তাই অশেষ কৌতূহল নিয়ে এসে তারাও যোগ দিয়েছিল আড্ডায়।
আড্ডা জমে উঠেছিল পুরোদমে। শীতের সন্ধ্যা। তার ওপরে লোডশেডিং। ডাইনিং টেবিলের ওপর জ্বলন্ত মোমবাতি ঘিরে গোল হয়ে বসে সকলে। পিন্টু-বিল্টুর মা বাটিতে বাটিতে জমাট নলেনগুড়ের পায়েস তুলে দিচ্ছিলেন সকলের হাতে। ঠিক তখনই গল্প শোনার আগ্রহে পিন্টু ধরে বসে দ্বিজুমামাকে―
‘গোয়েন্দাগিরির একটা গল্প বল না দ্বিজুমামা!’
সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ওঠেন দ্বিজুমামা ― ‘গল্প বলবো আমি? ওরে বাবা!’
কিন্তু ততক্ষণে পিন্টুর সমর্থনে সোচ্চার হয়ে উঠেছে সকলে।
‘দ্যাখ, গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করলেই কি কেউ গুছিয়ে গল্প বলতে পারে?’
পিন্টু বলল— ‘গুছিয়ে গল্প বলতে হবে না। তুমি তোমার মত করেই শোনাও।’
তাতেও রাজী হলেন না দ্বিজুমামা—‘ওরে, গল্প বলা একটা আর্ট। সবার দ্বারা সেটা হয় না।’
‘কত কত রহস্যের কিনারা কর তোমরা, কত কত ঘটনা ঘটে রোজ! এমন একটা ঘটনা বলতে পারবে না? কোন অভিজ্ঞতা নেই তোমার?’ বিল্টু বেশ পাকা বয়স্ক মানুষদের মত প্রশ্ন করে বসল।
দ্বিজুমামা মৃদু হেসে বললেন— ‘ঘটনা তো নিশ্চয় অনেক ঘটে! অভিজ্ঞতাও হচ্ছে রে! কিন্তু সে সব কথা বলতে নেই। সব চাকরীরই কিছু কিছু নিয়ম-নীতি থাকে যে!’
ছোট হলেও সকলে যেন কথাটা বুঝতে পারল। আর দমেও গেল সবাই।
মিতা হতাশ গলায় বলল— ‘আমরা গোয়েন্দা দেখব বলে পড়িমরি করে ছুটে এসেছি, জানো! দ্বিজুমামা তুমি খুব নিষ্ঠুর।’
একটু চুপ করে থেকে কি যেন ভাবলেন দ্বিজুমামা। তারপর বললেন —‘আমি যদি তোদের গল্প না বলে একটা মজার খেলা দেখাই! মানে, একটু গোয়েন্দাগিরি করে দেখাই?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই দেখাও! তাই।’ উল্লাসে ফেটে পড়ল সকলে।
‘বেশ। তোমাদের কি করতে হবে তবে মন দিয়ে শোন।’
নড়চড়ে স্থির হয়ে বসল সকলে।
‘একটু আগে ওপর তলার ঘরগুলোতে মনে হয় মোমবাতি জ্বেলে এসেছেন রাঙাদি!’ পিন্টু-বিল্টুর মায়ের দিকে আঙুল নির্দেশ করে দ্বিজুমামা বললেন।
পিন্টু-বিল্টুর মা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
‘তোমাদের মধ্যেকার যে কোন একজন গিয়ে ঠিক এই ঘরটির ওপরের ঘরের মোমবাতিটা নিয়ে আসবে জ্বলন্ত অবস্থায়। খুব সাবধানে, যেন কোনমতেই নিভে না যায়! আর এনে বসিয়ে রাখবে এই টেবিলে। আমি এখন একটু ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে যাচ্ছি। ঠিক দশ মিনিট পর আমি এখানে দাঁড়িয়ে বলে দেব মোমবাতিটা কে এনেছো—! ঠিক আছে?’
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল সকলে।
‘আর একটা কথা।’ হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল এমন ভাবে বাথরুমের দিকে দু’পা গিয়েও ফেরত এলেন দ্বিজুমামা, বললেন—‘কাজটি যে করবে, সে ছাড়া কেউ এই ঘরের বাইরে পা দেবে না এমনকি মোমবাতিটাও স্পর্শ করবে না!’ তারপর পিন্টুর মায়ের দিকে ফিরে বললেন— ‘রাঙাদি, সবাই যেন যে যার কাজে ব্যস্ত থাকে, তুমি দেখবে।’
এই বলে ঘরের বাঁদিকের দরজা পথে বাথরুমে চলে গেলেন দ্বিজুমামা।
সত্যিই ব্যাপারটাকে একটা মজার খেলা বলে মনে হল ছোটদের। দ্বিজুমামা গেছেন বাঁদিকের দরজা পথে বাথরুমে। আর তাদের মধ্যে যে কেউ একজন যাবে ডানদিকের দরজা দিয়ে ওপর তলায়। সুতরাং দ্বিজুমামার চোখে পড়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। তবু ঘরের বাঁদিকের দরজাটি ভেজিয়ে দিয়ে এল অতি সাবধানী বিল্টু। দেখা যাক, তবুও কী ভাবে ঠিক ব্যক্তিকে ধরতে পারেন দ্বিজুমামা!
নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একজনকে ঠিক করল পিন্টুরা। তারপর অসীম আগ্রহ আর কৌতূহল নিয়ে রইলো দ্বিজুমামার গোয়েন্দাগিরি দেখার অপেক্ষায়।
ঠিক মিনিট দশ পরেই গায়ে মাথায় তোয়ালে ঘষতে ঘষতে বাঁদিকের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন দ্বিজুমামা। টেবিলের ওপর মোমবাতির পাশে আর একটি মোমবাতি লক্ষ্য করে একটু মুচকি হাসলেন।
ঘর নিস্তব্ধ। কথা নেই কারও মুখে।
ধীরেসুস্থে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন দ্বিজুমামা। ঝুঁকে পড়লেনও একটু। তারপরই সকলকে স্তম্ভিত করে দিলেন তাঁর কণ্ঠস্বরে—‘মোমবাতি এনেছে টিঙ্কুবাবু।’
নীরবতা, মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আবার শোরগোল, চিৎকার— 'কী করে বললে দ্বিজুমামা, কি করে— বলো না?’
কপট গাম্ভীর্যে বললেন দ্বিজুমামা— ‘গোয়েন্দারা তা বলে না।’
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকারও দ্বিগুণ!
অবশেষে মুখ খুললেন তিনি— ‘দুটো জিনিস প্রথমেই তোমাদের কাছে পরিষ্কার করে দিই। এক, মোমবাতিটা আমি আনতে বলেছিলাম জ্বলন্ত অবস্থায়, নিভে যেন না যায়। আমার উদ্দেশ্য ছিল যে আনতে যাবে, আনতে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় তার ব্যয় করিয়ে দেওয়া! বাইরে আজ প্রবল উত্তুরে বাতাস। এই বাতাস আড়াল করে মোমের শিখা নিভতে না দিয়ে এতটা নিয়ে আসতে গিয়ে কম সময় লাগেনি টিঙ্কুবাবুর! দুই, ওই সময় এই ঘর থেকে কাউকে বেরোতে নিষেধ করার উদ্দেশ্য ছিল তোমাদের নিজের নিজের পায়েসের বাটিতে ব্যস্ত রাখা!’ প্রচ্ছন্ন হাসিতে মুখ ভরে উঠেছে দ্বিজুমামার, —‘দেখো, আমার উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল।’
সকলের বাটিগুলোর দিকে এক এক করে আঙুল নির্দেশ করে দেখান তিনি— ‘এই দেখো, তোমাদের সকলের বাটিই কমবেশি খালি, শুধুমাত্র টিঙ্কুর বাটিটা ছাড়া! এইটিতে হাত পড়েছে সবেমাত্র। মোমবাতি আনতে গিয়ে খাওয়ার সময় পায়নি বেচারা।’
অবাক বিস্ময়ে সকলে চেয়ে থাকে দ্বিজুমামার মুখের দিকে।
লেখক :সঞ্জীবকুমার দে