অবাক কান্ড! যে টুবলু খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করত সবসময়, সেই টুবলু মাঝে মাঝেই দৌড়ে এসে মাকে বলছে মা, মা আমাকে একটা বিস্কুট দাও। কখনো আবার একমুঠো মুড়ি চাইছে। টুবলুর মা মনীষা আন্টি খুব খুশি হয়েছে। যাক আর চিন্তা নেই, শুধু দুধটা যদি ঢক্ ঢক্ করে খেত! তাহলে আর আন্টিকে বক্ বক্ করতে হত না।
আন্টির কথা পরে হবে, এখন টুবলুর কথা শোনো। টুবলু গত সপ্তাহে দিদুন বাড়ি মধুরাপুর গিয়েছিল। ওখানে গেলে টুবলু খুব খুশি হয়। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা ছাড়াও বাতাবি লেবুর গাছ আছে দুটো। বাতাবি লেবুর গাছে নালসে পিঁপড়ের বাসা দেখে কি লাফালাফি! একবার দিদুনকে ডাকে, একবার দাদুকে, দেখো দেখো পিঁপড়েগুলো মুখে করে ফড়িং নিয়ে যাচ্ছে। দিদুন তখন নাতির পছন্দের মালপোয়া ভাজছিল, টুবলুর হাঁক ডাকে যেতেই হল। তারপর পিঁপড়ে নিয়ে কত প্রশ্ন, দিদুন বেশ মজার একটা ছড়া শুনিয়ে তখনকার মত টুবলুর হাত থেকে ছুটি পেল, তবে কথা দিতে হল দুপুরবেলা টুবলুকে পিঁপড়ের গল্প শোনাতে হবে।
টুবলু কি একাই গল্প শুনবে? কক্ষনো না, আমরাও শুনবো। তাহলে চলো আগে সেই মজার ছড়াটা শুনে নিই। ‘পিলপিল পিঁপড়েরা ছয় পায়ে চলে / যেতে যেতে চুপিসাড়ে কত কথা বলে / চুপ করে বসে তুমি কান পেতে শোনো / জমা হল কত দানা মনে মনে গোনো।’ এইটুকু শুনেই টুবলুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বাব্বা অতগুলো পা! ওদের হাত নেই কেন? আরো যে কত প্রশ্ন। এই সময় মেঝের দিকে নজর পড়তে দেখে কয়কটা লাল খুদে পিঁপড়ে চলেছে একটা মুড়িকে টানতে টানতে, আরে কয়েকজন বিস্কুটের টুকরো ও নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাস হয়ে গেল! টুবলু দিদুনের কোল থেকে লাফিয়ে নেমে দেখতে লাগলো ওরা খাবার নিয়ে কোথায় যাচ্ছে। দিদুনের পুরনো বাড়ি, মেঝেতে অনেক ছোট ছোট ফাটল আছে। পিঁপড়েরা খাবার নিয়ে সেই ফাটলে ঢুকে যেতেই টুবলুর চেঁচামেচি, দিদুন আমি ওদের বাড়ি দেখব।
টুবলুটা খুব বোকা, নালসে পিঁপড়ে গাছের পাতা জুড়ে জুড়ে বাসা করে তাই ওদের বাসা দেখা যায়, ডিম দেখা যায় কিন্তু মাটির তলায় যে সব পিঁপড়ের বাসা তাদের কি দেখা যায়? তাহলে তো ওদের মত ছোট হয়ে যেতে হবে তাই না? দিদুন অনেক বুঝিয়ে টুঝিয়ে শান্ত করে বলল, ওদের বাসা দেখতে গেলে ওরা কি তোমাকে ছেড়ে দেবে? ওরা ছোট হতে পারে কিন্তু খুব বুদ্ধি ওদের। কাঠ পিঁপড়েরা সব থেকে বিষাক্ত, ওরা যদি পাঁচ ছ’জন মিলে কামড়ায় তাহলে যন্ত্রনায় জ্বর এসে যাবে। আর ওই ছোট্ট ছোট্ট লাল পিঁপড়ে কামড়ালেও খুব জ্বলবে। আরো একরকম পিঁপড়ে আছে ওরা কালো মোটা বড় সড়, ওগুলো ডেঁয়ো পিঁপড়ে। ডেঁয়ো পিঁপড়ে যদি দেখে শত্রু আসছে সামনে তাহলে শরীরের পিছনদিক উঁচু করে সামনের পা উঁচু করে মুখ হাঁ করে তেড়ে এসে কামড়ে দেবে। এত জোরে কামড়ে দেবে জোর করে ছাড়াতে গেলে হাত কেটে রক্ত বেরোবে। এইটুকু শুনেই টুবলু বলল ওরা ভালোনা, খুব বাজে। তোমাদের ও তাই মনে হচ্ছে? ওরা সবাই খুব বাজে? না, না ভয় পেয়ো না, সবাই খারাপ নয়। কালো কালো ছোট পিঁপড়ে খুব ভালো, ওরা গায়ে উঠলে মনে হয় সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
আচ্ছা দিদুন এত কথা জানলো কী করে? টুবলুর প্রশ্নের উত্তরে দিদুন বলল, শুধু এইটুকু নয় দিদুন আরো অনেক কিছু জানে। যেমন ওরা মুখে করে খাবার নিয়ে গিয়ে জমিয়ে রাখে, যখন খাবার পাওয়া যায় না তখন বসে বসে খায়। ওরা ওদের শরীরের ওজনের চেয়ে ২০ গুন বেশি ওজন বইতে পারে। এই কথা শুনে টুবলু খুব আনন্দ পেয়েছে। টুবলু ঠিক করেছে ও খাবার জমাবে। বাবা বাজার না গেলে সেই খাবার সবাই মিলে খাবে। কিন্তু টুবলুর সঙ্গে দিদুনের এইসব গল্প হয়েছে সেটা তো মনীষা আন্টি জানেনা। জানলে বুঝতে পারতো টুবলু বিস্কুট, মুড়ি, টফি নিয়ে কি করছে!
তোমরা বুঝতে পেরেছ? তোমরাও পারলে না? কিন্তু দিদুন পেরেছে। ফোনে মনীষা আন্টি যেই দিদুনকে বলেছে তখুনি দিদুন বুঝে গেছে টুবলু খাবার জমাচ্ছে। কিন্তু কোথায়? টুবলুকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল পিগি ব্যাঙ্কে খাবার জমাচ্ছে। কী কান্ড! শো কেসের মধ্যে পিগি ব্যাঙ্ক তখন পিঁপড়েদের দখলে। হবেনা? ওরা যে বিস্কুট, টফি, মুড়ির সন্ধান পেয়েছে। তারপর যা হল পিগি ব্যাঙ্ক খুলতে দেখা গেল চিনির দানা, টফি গলে গিয়ে টাকাগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে। টুবলুকে মনীষা আন্টি কিন্তু একটুও বকেনি। ও তো এখন খুব ছোট, তাই ও জানেনা পিগি ব্যাঙ্কে খাবার জমাতে নেই। পিঁপড়েরা যা করে তাই কি করা যায়? তবে হ্যাঁ, ওদের কাছেও অনেক কিছু শেখার আছে। তোমরাও বড় হয়ে ওদের কথা পড়বে, অনেক কিছু জানতে পারবে। জানো ওরা সবাই মিলেমিশে কলোনি বানিয়ে থাকে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করেনা। বিজ্ঞানী গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য ওদের নিয়ে গবেষণা করে বই লিখেছেন। কবিরা কত কবিতা ছড়া লিখেছেন। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “পিঁপড়ে/ ভাঁড়ার ঘরে কী করে?/এটা খায় ওটা খায়/পিঁপড়েনিকে গান শোনায়।” আর আমাদের সব্বার প্রিয় রবিঠাকুর সেই ছোট্টবেলায় লিখেছিলেন, “আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি/ সন্দেশ মাখিয়া দিই তাতে/ হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ,/ পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।”
ছড়া তো শুনলে আর একটা কথা শুনবে? তার আগে প্রমিস করতে হবে টুবলুকে বলবে না, তাহলে খুব দুঃখ পাবে। একেই জন্মদিনে উপহার পাওয়া টাকা নষ্ট হয়ে গেছে বলে খুব মনখারাপ। ভেবেছিল ওই টাকা দিয়ে রাস্তায় যে কুকুরগুলো থাকে ভোলু, নেড়ু ওদের সোয়েটার কিনে দেবে। শীতে ওদের কষ্ট হয় যে, তাই। যাকগে সে কথা, আন্টি কিনে দেবে ভোলুদের সোয়েটার। এখন ওই কথাটা শোনো, টুবলু পিগি ব্যাঙ্কে লঙ্কা, সিম, বেগুন আলুর টুকরো এমনকি টম্যাটো জমিয়েছিল। ওই যে যেদিন আঙ্কেল বাজারে যেতে পারবে না সেদিন আন্টি টুবলুর জমানো সবজি রান্না করবে। হাসছ তোমরা? আস্তে, আস্তে পিঁপড়েদের মতো শব্দ না করে, টুবলু যেন না শোনে!
সমাপ্ত
লেখক : সবিতা বিশ্বাস