দমকা হাওয়ায় শাল গাছের দিকে বাঁশবনের সারি যেন এলিয়ে দিল নিজেকে।
‘এই বাঁশ থাম না। কী যে করিস না, কটকট মটমট।‘
‘আরে তুই কী করিস খালি খসখস, যেন ভুতের বাড়ি। পাতা তো নয়, যেন মস্ত বড় থালা। আর তাতেই হয়েছে জ্বালা।‘ বাঁশঝাড় আবার শালের দিকে হেলে পড়ে।
‘আরে, আরে, আরে,
থাম রে যত আহাম্মকের দল।
তোদের জ্বালায় মরছি আমি টলমল।
হয় বাঁশ বেটা কাত হয়ে নতজানু,
নয়ত শালের পাতা অযথা পড়ে ভারি ভারি।
ফার্ণের অমন নরম দেহ ধূলিসাৎ হয় বারে বার।
তোরা কী বুঝিস, জ্বালা যত আমার!‘
এইসব যেন গুনগুনিয়ে ওঠে প্রকৃতি পরিবেশে।
তারপর আবার এক পশলা বৃষ্টি ও হাওয়ার দাপট।
ঝিঁঝিঁ গুলোও সুর ধরেছে একটানা। তারই মাঝে পাখিদের খিল খিল গল্প। কেউ বলে,’কু কু কু...‘ তো কেউ ডাকে,’টক টক টক টক’, কেউ বা শুধায় ‘টি টি টি টি টিওওওওও’? আবার কেউ উত্তরে দেয়, ‘টু রু রু রু, টু রু রু রু।‘ এরমধ্যেই ছাগল গুলো ব্যা ব্যা করে পাতা ছিঁড়ছে। আবার লাফালাফি ও কম নয় তাদের! তাই ফার্ণের হল গিয়ে উভয় সংকট। একদিকে বড় গাছ অন্য দিকে কানে তালা ধরিয়ে দিল ঝিঁঝিঁর দল। তার ওপরে ছাগলছানার লাথি ও ওদেরই খাবার হয়ে যাওয়া। মাটির সঙ্গে লেগে থাকার এই এক কষ্ট। বাগ পোকাগুলো আজকাল আবার চড়চড়িয়ে বাড়ছে। পাতার উপর ফুরফুরিয়ে উড়ছে। তাদের যত গল্প রাশি প্রাণ ভরায় খুব, কিন্তু এই বৃষ্টিখানায় বন্ধ তাদের আনাগোনা। কখনো বা রোদ্দুর এক চিলতে এ পথ মাড়ায়। ঐ যে ওই শালের রাশি হাওয়ায় দোলে বাজায় বাঁশী। দোলন যত লাগে পাতায়, রোদের ঝলক আসে ফার্ণের আঙিনায়।
এই নিয়েই বনবাদাড়ের রোজনামচা। সকাল হয় পাখির ডাকে, সারাটা দিন গাছগাছালি, সবুজ বন আগলে রাখে। সন্ধ্যে হলেই আঁধার নামে, ছাগলছানা বাসার দিকে পা বাড়ায়। পাখির কুহুতান ঘুমের জগতে মুর্ছা যায়। আর তখনই শুরু হয় রাত্রির অভিযান। এই অভিযানকেই যে বড্ড ভয় গুঞ্জনের।
গুঞ্জনের কাছে রাত্রি একটা বিভীষিকা। সূর্যের আলো যখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে গুঞ্জনও যেন গুটিয়ে যায়। কান পেতে শোনে মাটির শব্দ। কখনো কখনো জানলার কপাট খুলে গাছেদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘শুনতে পাচ্ছিস কি?’ আর এসবই হয়েছে গত বার তিস্তা ভেসে যাওয়ার পর থেকে। উফ কী ভয়ঙ্কর সে রাত! গুঞ্জনের কাছে আঁধার অভিযান, আজও ভাবলে শিহরণ জাগায়!
গুঞ্জন, একটি পাহাড়ী ছেলে, থাকে দার্জিলিঙ জেলার ছোটা মাঙ্গয়া নামে এক গ্ৰামে। তিস্তা বাজারের পর যে রাস্তাটা ওপরের দিকে উঠে গেছে, ঐ দিকে এসে টাকলিং হয়ে আরো খানিকটা ওপরে উঠে এসে তাদের গ্ৰাম। গ্ৰামে আছে গোটা চারেক বাড়ি। নাহ কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। সেজন্য যেতে হয় কিছুটা নেমে টাকলিঙে। সেখানে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র মতো আছে।
আর স্কুল? স্কুল বলতে এক কিলোমিটার পথ হেঁটে গিয়ে দাঁড়াতে হয় পিচ রাস্তায়। সেইখানে একটিমাত্র মুদিখানার দোকান। তার কাছে আসে স্কুলবাস। তারপর নীচে নেমে যায় তিস্তা বাজারে। ওখানেই স্কুল, ওখানেই বাজার-হাট আর ওখানেই যত রকমারি ব্যবস্থা, কোলাহল।
গাছগাছালি, পশুপাখি, পোকামাকড় সবার সঙ্গে এভাবেই কথা বলে গুঞ্জন। ছোট্ট বোনকেও নিয়ে যায় মাঝে মাঝে জঙ্গলের আনাচে কানাচে। কখনো কখনো এক একটা পোকা ধরে নিয়ে আসে দেশলাই বাক্সে। কিছুদিন রেখে আবার বনে ছেড়ে দিয়ে আসে। ওদের বাড়িতেও মৌমাছির চাষ হয়। সেখানে ওদের যাওয়া মানা। বাবা বলেন, ডাইনোসর জোন ওটা। ধেয়ে এসে এমন কামড়ে ধরবে না! আর সেকি জ্বালা! তাই ওই পথ ভুলেও মাড়ায় না ওরা দুজন।
দিনটা ছিল শনিবার। সবেই পড়া থেকে উঠেছে গুঞ্জন। বোন খুব বায়না ধরেছে পাস্তা খাওয়ার। মা তখন ঠাকুমার সাথে রান্নাঘরে ব্যস্ত। আজকে তার বাবার আসার কথা। বাবা কাজ করেন আর্মি ফোর্সে, সুদূর কাশ্মীরে তাঁর পোস্টিং। একদম বর্ডার এরিয়ায়। সারাটাদিন তাই মা, ঠাকুমা বুদ্ধদেবের কাছে প্রার্থনা করেন বাবা যাতে সুস্থ ভাবে ফিরে আসেন। আজ সেইদিন। গুঞ্জন ও তার বোন দুজনেই খুব উত্তেজিত। কতদিন পর বাবার সাথে দেখা হবে। কত কথা কত গল্প বলা বাকি। বাবাই তো চিনিয়েছিলেন এই প্রকৃতি, ওদের কথা, ওদের সাথে বন্ধুত্ব তো বাবাই শিখিয়েছিলেন। নয়ত এই একরত্তি গ্ৰামে কি করে থাকত গুঞ্জন। ওর খেলার সাথি ওর মন খারাপের সঙ্গী সবই তো এই পরিবেশ। বাবার কাছে খবর পাঠাতে এই গাছকেই তো ফিসফিসিয়ে বলে আসত গুঞ্জন। হাওয়ায় হাওয়ায় খবর যেত কাশ্মীরে। আর তাই তো বাবা যখন বাড়ি ফিরতেন ঠিক সেটাই আনতেন , যা গুঞ্জন বলে এসেছিল গাছেদের। এইসব ভাবনার মাঝেই ঘরটা যেন দুলে উঠল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রান্নাঘরের দিক থেকে ঝনঝন করে শব্দ এলো। কাঠের মেঝেতে গুঞ্জন ও তার বোন একদম থ। তাক থেকে একে একে বইগুলি মেঝেতে পড়তে লাগল।
‘গু-উ-উ-ন-জ-ও-ও-ন....’।
মায়ের ডাকে হুঁশ ফেরে। বোনকে কোলে নিয়ে ক্লাস থ্রি এ পড়া গুঞ্জন হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে তখন হুলুস্থুল। অন্ধকারের মাঝে ধূলোর রাশি। গাছপালা সব উথালপাথাল। তার মধ্যে তীব্র বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন অঝোর নয়নে কাঁদছে। কোনরকমে রান্নাঘরের দিকে যেতেই দেখে ধূলো তো ওখানে থেকেই উড়ছে। কোথাও খুঁজে পায় না মা-ঠাকুমাকে। নীচের দিক থেকে চিৎকার শোনা যায়। বোনকে নামিয়ে মাটিতে কান পাতে গুঞ্জন। শোঁ শোঁ শব্দ টলটল করে বয়ে চলেছে। ভয়ে ঠুকরে ওঠে সে। বোনকে কোলে নিয়ে জঙ্গলে পা বাড়ায়। ঝড়ে জলে পাগলের মতো মা-কে খুঁজতে থাকে। কাদা মাটিতে হড়কে যায় হঠাৎ! ফার্ণের পাতা আঁকড়ে ধরে থাকে। বোনের কাছে তখন দাদা-ই বাবা। কোন রকমে গিয়ে পৌঁছায় শাল বাঁশেদের কাছে। জড়িয়ে ধরে গাছের গুঁড়ি, বোনকে পিঠে নিয়ে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে দুজনে। এভাবে কতক্ষণ জানা নেই। পাখির ডাকে চোখ খোলে। দেখে পুব আকাশে রক্ত বর্ণ আলো। জল সপসপে জামায় দুই ভাই বোন। এক পা এক পা করে ঘরের পথে পা বাড়ায়। নীচের ঐ বাঁকটা পেরোলেই ওদের ঘরটা দেখা যায়। কিন্তু বাঁক পেরিয়েও কোনো ঘর চোখে পড়ল না। শুধু কিছু ধ্বংসস্তূপ। ফ্যালফেলিয়ে ভাইবোন একে অপরের দিকে তাকায়। ঠিক তারপরই বোন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ‘মা – আ-আ-আ’।
এক মুহুর্ত যেন কিছু ভাবে গুঞ্জন। তারপর বোনকে বসিয়ে দৌড়ে যায় ঘরের কাছে। সবই তো ধ্বংসস্তূপ। এক দুটো কাঠ কচি হাতে সরিয়ে দেখার চেষ্টা করে। বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। আশপাশের গাছপালা সব এফোঁড় ওফোঁড় করে আছে। জঙ্গলে কে যেন তাণ্ডব করে গেছে! মৌমাছিরা ভনভন করে উড়ছে। সবাই যেন দিশেহারা। সে ফিরে আসে বোনের কাছে। বোন তখনো ফোঁপাচ্ছে। বোনকে কোলে নিয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে গুঞ্জন।
গ্ৰামের বাকি বাড়িগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেছে জানে না সে। তিনটি বাঁক ঘুরলে তিস্তা দেখা যায়। ভয়ে ভয়ে পা বাড়াচ্ছিল গুঞ্জন। ও জানে কাল রাতের শোঁ শোঁ শব্দ আসলে তিস্তারই জলরাশি। মাটিতে কান পেতে, এভাবেই আওয়াজ চিনতে শিখিয়েছিলেন বাবা। বলেছিলেন, শহর থেকে লোকজন এসেছে, তিস্তায় বাঁধ দিচ্ছে, এতে খারাপ ভালো দুই হয়। ভয়ের মধ্যে হল গিয়ে বাঁধে যদি ফাটল ধরে আর কেউ বাঁচব না রে গুঞ্জন। ছোট্ট গুঞ্জন জিজ্ঞেস করেছিল,’কেন বাবা?’ বাবা বলেছিলেন, ‘অগ্ৰগতি। সভ্যতা এগিয়ে চলছে। বুঝলি রে গুঞ্জন। জল ধরে রাখতে বাঁধ দিচ্ছে। ওপরের থেকে আসা জল ধরে রাখছে। কিন্তু যখন বেশী জল আসবে ধরে রাখবে কি করে। জল তো ছাড়তেই হবে। সব ভেসে যাবে। আর জলের চাপে বাঁধ ভাঙলে অনাসৃষ্টি হবে, তলিয়ে যাবে সব। পাহাড়ে তো মাটির নীচ দিয়ে জল অনেকটাই ঢুকে আসে। নরম করে দেয় মাটি। ধ্বস নামে তখনই। ভূমিকম্পের আকারে খসে পড়ে বাড়িঘর গাছগাছালি।' সব শুনে গুঞ্জন বলেছিল,’মানুষ কী চায় বাবা? মানুষ কি খুব বাজে?’ বাবা হেসেছিলেন, আর গুনগুনিয়ে বলেছিলেন, ‘সবই সভ্যতার আধুনিক ধাপ। কলিযুগের বহর। হায় রে বিধাতা, কী ভয়ঙ্কর পরিহাস।‘ এত ভারি ভারি কথা বোঝেনি সেদিন গুঞ্জন। কিন্তু এখন যেন সবটাই পরিস্কার।
এইসব আগাপাস্তলা ভাবতে ভাবতে তৃতীয় বাঁক ঘুরতেই দেখে কুলকুলিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী তিস্তা। ওপাশের পাহাড়ের রাস্তা গেছে ধ্বসে। নীচ থেকে শব্দ আসে কান্নার। ভয় যেন চাদরের মত মুড়িয়ে ধরল ওদের। বোন একবার ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ দাদা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?‘ গুঞ্জন কোন উত্তর দিতে পারে না। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে টাকলিঙের দিকে। পথে পড়ে থাকে অজস্র গাছপালা। একরাতে কে যেন এসে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে সব।
টাকলিং স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গেট খুলে ঢুকতেই দেখে আর্মি পোশাকে কে যেন দাঁড়িয়ে ইতস্তত পায়চারি করছে করিডোরে। একজন নার্স একটা ট্রে নিয়ে দৌড়ে গেলেন অন্য ঘরে। পিছন পিছন সাদা পোশাকের একজন। গলায় তার স্টেথোস্কোপ। তার মানে ডাক্তার বাবু। আর্মি পোশাকের লোকটির সাথে কী সব বলে অন্য ঘরে ঢুকে গেলেন ডাক্তারবাবু। আর্মির টুপি খুলে পিছনে ফেরে লোকটি।
‘বা – আ- আ- বা – আ- আ- -‘
এক ছুটে গুঞ্জন আর তার বোন জড়িয়ে ধরলো। বাবাও ওদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলেন। বাবার পিঠে মুখ রাখতেই, গুঞ্জন দেখতে পেল মাকে। একটা বেডে শোয়ানো আছে। ঠাকুমা দূরে বসে। কপালে সামান্য ছোট পেয়েছে। মায়ের হাতে প্লাস্টার হচ্ছে। কপালের অনেকটাই অংশ ফাটা। সাদা কাপড়ের ব্যাণ্ডেজ ভিজে লাল। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মা।
গুঞ্জন আরো একটু জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। কানের কাছে মুখ এনে বলল,’সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া ভালো নয় বাবা। মানুষ বড্ড বাজে। গাছগুলো খুব কাঁদছে বাবা। পাখির বাসা পড়ে ভেঙে গেছে। মৌমাছিরা পালাচ্ছে। পাহাড় বড় কাঁদছে বাবা। তিস্তা নদী ফুঁসছে। আঘাতের রক্ত যেন আকাশের গায়ে ফেটে পড়েছে। পৃথিবীটা বোধহয় ডুবে যাচ্ছে। হারিয়ে গেছে বাড়ি। হাহাকারের জনস্রোতে ডুবতে বসেছে পৃথিবী। বাবা-আ-আ, বড্ড ভয় করছে আজ। এ পাহাড়, এ জঙ্গল কিছুই কি থাকবে না আর? বাঁচাতে কি পারব না আমরা? পারব না বাবা?‘
বাবার চোখে জল ছলছল। নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘লোভ বড় ভয়ঙ্কর,
সর্বনাশী শিখায় জ্বলছে জগৎ পর।
আয় রে তোরা আমার কোলে,
ধরব কঠিন দাঁড়া।
ভাঙব যত বিপত্তি আজ,
বাঁচব ভুবন সারা।
গুঞ্জনে দুলবে ভ্রমর,
উড়বে যত পাখি,
সুর তুলবে গাছগাছালি,
জোনাকি হবে সাথী।
দেখবি তখন মানুষ জাতি
করবে তাদের ভয়,
প্রকৃতি আজ হার মেনেছে,
কাল করবে জয়।‘
-শর্মিষ্ঠা চ্যাটার্জী