আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে, সে এক নাম না জানা দেশে আকাশের দেবতা নিয়ামে প্রথম মানুষকে তৈরী করেন। পৃথিবীতে মানুষের থাকার জন্য নিয়ামে তাদের খাবার জন্য ধান দিয়ে গেলেন, তেষ্টা মেটানোর জন্য নদীতে জল দিয়ে গেলেন, শীত থেকে বাঁচার জন্য আগুন দিয়ে গেলেন। কিন্তু সারাদিন খাবার আর জল খাওয়ার পর মানুষ হাঁফিয়ে উঠলে সন্ধ্যেবেলা আগুনের ধারে সবাই মিলে বসবে, তখন তাদের জন্য গল্প দিয়ে গেলেন না। পৃথিবীর যত গল্প ছিল, সব এক ঝুলিতে ভরে নিয়ামে নিয়ে চলে গেলেন সেই মেঘের দেশে।
মানুষের এই দশা দেখে কিন্তু একজনের খুব খারাপ লাগল। সে হল গাছের ডালে ডালে ঝুলে জাল বানানো মাকড়সা আনানসে।
আনানসে দেখে প্রতিদিন বিকেলে সুয্যি ডুবে গেলেই মানুষগুলো সব তাদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেরাও ঘুমিয়ে পড়ে।
ইস্, যদি বাচ্চাগুলোকে শোনানোর মত গল্প থাকতো !
একদিন তাই অনেক ভেবেচিন্তে আনানসে ঠিক করল, যে সে নিজেই যাবে এবার নিয়ামের কাছে।
নিয়ামের থেকে চেয়ে ফিরিয়ে আনবে পৃথিবীর সব গল্প।
যেমন ভাবা তেমন কাজ।
পরের দিন আকাশে আলো ফুটতেই আনানসে লেগে পড়ল এক বিশাল জাল বানাতে।
এক দিন… দুই দিন… তিন দিন কেটে গেলো। আনানসে জাল বুনেই চললো। দেখতে দেখতে সেই জাল লম্বা হতে হতে একসময় এসে পৌঁছলো মেঘের দেশে, যেখানে নিয়ামের বাড়ী।
নিয়ামে তো অত উঁচুতে আনানসেকে দেখেই অবাক! এত ছোট্ট একটা মাকড়সা পৃথিবী থেকে জাল বুনতে বুনতে এসে পড়েছে তাঁর দেশে!
তিনি আনানসেকে জিজ্ঞেস করলেন গম্ভীর গলায়,
- কী ব্যাপার, পৃথিবীর মাকড়সা? এখানে কী দরকার তোমার?
আনানসে কিন্তু মেঘের মধ্যে বসে থাকা নিয়ামে কে দেখে একটুও ঘাবড়ালো না। সে একটা মস্ত পেন্নাম ঠুকে বলল,
- আজ্ঞে, আমি আনানসে। শুনেছি পৃথিবীর সব গল্প নাকি আপনার কাছে জমা হয়ে আছে। আমি সেই গল্প ফেরৎ নিয়ে যেতে এসেছি, পৃথিবীর মানুষের জন্য।
ছোট্ট আনানসের কথা শুনে তো নিয়ামে হেসেই বাঁচে্ন না। প্রায় মিনিট দশেক পর তার হাসির বেগ কমলে পরে নিয়ামে ভাবলেন যে এর সঙ্গে একটু রগড় করা যাক। তিনি আনানসের দিকে তাকিয়ে বললেন,
― সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু এত গল্প, এ তো যাকে তাকে দেওয়ার জিনিস নয় বাপু। এই সব গল্প নেওয়ার আগে তোমায় পরীক্ষা দিতে হবে, যে এই সব গল্প নেওয়ার ক্ষমতা তোমার আছে কিনা।
- কী পরীক্ষা দিতে হবে বলুন?
জিজ্ঞেস করলো আনানসে।
গম্ভীর গলায় নিয়ামে বললেন,
- যদি তুমি জঙ্গলের দুর্দান্ত অজগর ওনিনি, ভয়ঙ্কর চিতাবাঘ ওসেবো আর মারাত্মক ভীমরুল মোবোরোর ঝাঁক আমার সামনে নিয়ে আসতে পারো, তাহলেই তুমি পৃথিবীর সব গল্প আমার থেকে নিয়ে যেতে পারবে। এই নাও তোমার এই কাজে সাহায্যের জন্য আমার এই জাদু ঝোলা খানি তোমায় দিলুম। এই ঝোলায় যত ইচ্ছা জিনিস তুমি ভরতে পারবে, আর একবার এর মুখ বন্ধ করে দিলে তুমি ছাড়া আর কেউ সেই মুখ খুলতে পারবে না।
নিয়ামের নেওয়ায় সেই ঝোলাটা পেয়ে, নিয়ামেকে একটা লম্বা সেলাম ঠুকে আনানসে তখনই আবার পৃথিবীতে ফেরার পথ ধরল।
ফিরেই আনানসে সেই নদীর দিকে পা বাড়াল যেখানে ওনিনি নামের সেই বিশাল অজগর থাকত। তবে সেখানে যাওয়ার আগে সে জঙ্গল থেকে খুঁজে পেতে একটা লম্বা বাঁশ আর কিছু লতাপাতা নিজের সেই ঝোলার মধ্যে ভরে নিল।
নদীর ধারে পৌঁছে আনানসে দেখল যে ওনিনি সেখানে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে দুপুরের ঘুমের ব্যবস্থা করছে। সে আনানসেকে দেখে একটা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
- কী হে? কী চাই?
- আজ্ঞে, আমি আনানসে। একটা খুব কঠিন সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি, যদি একটু সমাধান করে দিতেন...
- কী সমস্যা?
- আজ্ঞে জঙ্গলের কয়েকটা মুখ্যু পাখী বলাবলি করছিল যে ওরা ঐ বাঁশ গাছের টঙে উঠে বসলেই আপনি নাকি ওদের নাগাল পান না। আমি একদম তেড়ে গেছি কথাটা শুনে। আপনি ওনিনি... আপনার থেকে লম্বা এই জঙ্গলে কিছু আছে নাকি... ছো ছো...তবে ব্যাটারা আমার কথা মানতেই চাইছে না। খালি বলে প্রমাণ চাই, প্রমাণ। তাই আমি একটা বাঁশ সঙ্গে নিয়েই এসেছি। এবার আপনি যদি একটু কষ্ট করে সেটার পাশে শুয়ে পড়েন তাহলেই হবে...
এই কথা শুনে অজগরের ঘুম মাথায় উঠে গেলো। সে তখনই জল ছেড়ে উঠে এলো আনানসের আনা সেই বাঁশটার কাছে। মুহূর্তের মধ্যে পাকে পাকে জড়িয়ে ফেললো সেটাকে। আর যেই না জড়িয়ে ফেলা অমনি আনানসে সঙ্গে আনা লতাপাতা গুলো দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেললো ওনিনিকে আর ভরে ফেলল নিজের ঝোলায়।
এরপর আনানসে চলল সেই রাস্তার দিকে যেখান দিয়ে চিতাবাঘ ওসেবো রোজ বিকেলে হাঁটতে বের হত। সে গিয়েই নিজের আটখানা হাত দিয়ে সেই রাস্তার ওপর একটা গর্ত খুঁড়তে লেগে গেল। গর্তটা গভীর হতেই আশপাশ থেকে কতগুলো বড় বড় পাতা এনে সেই গর্তটা ঢেকে দিল সে। আর যায় কোথায়, বাঘ বাবাজী যেই না ঐ রাস্তার ওপর এসেছে সঙ্গে সঙ্গে সোজা ঢুকে গেছে সে গর্তে।
আনানসে গর্তের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল,
― ওসেবো মশাই, ঠিক আছ তো?
ওসেবো নীচ থেকে চেঁচিয়ে বলল,
― কে রে? আনানসে নাকি? বড্ড বিপদে পড়েছি রে বাবা? দেখনা কাছে পিঠে কোন দড়ি-টড়ি কিছু পাস কিনা তাহলে আমি বেঁয়ে একটু উঠি।
- দাঁড়াও, হাতের কাছে দড়ি নেই, তবে একটা ঝোলা আছে। তুমি সেই ঝোলার মধ্যে ঢুকলেই আমি আমার জাল দিয়ে তোমায় তুলে নেব।
বলে সে ঝোলার মুখটা খুলে গর্তের মধ্যে নামিয়ে দিতেই ওসেবো মারল এক লাফ তার মধ্যে, আর সঙ্গে সঙ্গে আনানসে জাল ছুঁড়ে সেই ঝোলার মুখ করে দিল বন্ধ।
সব শেষে এলো ভীমরুল মোবোরো আর তার ঝাঁকের পালা। মোবোরো একা নয় যে তাকে বোকা বানিয়ে কাজ হাসিল হয়ে যাবে, তার সাথে দলবল আছে। তাদের একজনও যদি আনানসের চালাকি ধরে ফেলে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে হুল উঁচিয়ে তেড়ে আসবে তার দিকে।
অনেক ভেবে একটা ফন্দি আঁটল সে। গাছের পাতার উপর লাফিয়ে বেড়ানো বুড়ো ব্যাঙের কাছে সে শুনেছিল যে ভীমরুলরা বৃষ্টিকে ভয় পায়। তাই সে কী করলো জঙ্গল থেকে একটা কুমড়োর শুকনো খোল নিয়ে তাতে জল ভরে নিয়ে চলল সেই ভীমরুল মোবোরোর চাকের দিকে।
চাকের কাছে পৌঁছে আনানসে কুমড়োর খোল থেকে জলের ছিটে দিতে লাগল ভীমরুলের মাটির তৈরী চাকে আর জোরে জোরে চেঁচাতে লাগলো,
বৃষ্টি এসেছে...বৃষ্টি...
তার সেই চেঁচানি শুনে মোবোরো চাকের ভিতর থেকে গুনগুন করে বলে উঠলো,
― আনানসে...আনানসে... কিছু একটা উপায় করো... নইলে আমাদের চাক যে ভেসে যাবে...
আনানসে চেঁচিয়ে উত্তর দিল,
― কিচ্ছু চিন্তা নেই, এই আমার কাছে একটা খালি কুমড়োর খোল আছে। আমি সেটায় একটা গর্ত করে তোমাদের চাকের মুখে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা কোন দিকে না তাকিয়ে সেটায় ঢুকে পড়।
এই বলে আনানসে কুমড়োর খোলের বাকী জলটা চাকের ওপর ছেটাতে ছেটাতে খোলের গর্তটা একদম চাকের মুখে নিয়ে যেতেই সমস্ত ভীমরুলের দল ভোঁ ভোঁ করতে করতে তার মধ্যে ঢুকে দিলো; আর সঙ্গে সঙ্গে আনানসে নিজের একটা চমৎকার জাল দিয়ে সেই খোলের মুখটা বন্ধ করে দিয়ে, পুরে ফেলল নিজের ঝোলায়।
তারপর আর কী, আনানসে সোজা এসে দাঁড়াল নিয়ামের সামনে। নিয়ামে এতক্ষণ আকাশ থেকে সবই দেখছিলেন। তিনি আনানসের সবকটা হাতের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন,
- ধন্যি...ধন্যি তোমার বুদ্ধি আনানসে, নিজের থেকে অনেক গুন বড় অজগরকে, অনেক গুন শক্তিশালী চিতাবাঘকে আর দলে অনেক ভারী ভীমরুলদের তুমি শুধু বুদ্ধি খাটিয়ে জব্দ করেছ...
এই বলে তিনি তার কাছে থাকা সব গল্প আনানসের ঝোলায় ভরে দিলেন।
আর আনানসে সেই গল্পের ঝোলা থেকে সব গল্প ছড়িয়ে দিল পৃথিবীর সব ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে। সেই থেকে শুরু হল গল্পের জাল বোনা।
উপসংহার:
সেই থেকে শুরু তাহলে গল্প বোনার পালা, যা আজও চলছে সমান তালে। আজকের এই গল্পটি আসলে একটি আফ্রিকান রূপকথা, যা বহু যুগ আগে হয়তো শুনিয়েছিলেন কোন আদিম গল্পকার, তারপর তা ছড়িয়ে পড়েছিল আকাশে বাতাসে। আমরাও এটাই বিশ্বাস করি কোন গল্পকে ঝোলার মধ্যে বেঁধে রাখলে চলে না, তাকে ছড়িয়ে দিতে হয় আকাশে বাতাসে, খোলা হাওয়ায়। গল্প ছড়িয়ে পড়ে ছোটদের হাসিতে, ছড়িয়ে পড়ে পাখীদের কিচিরমিচিরে।
লেখক : অঋণ সেন