Image-Description
Stories
আম পার্বণ
Apr 29 2024 Posted by : montajpublishing

একেই তো ভীষণ গরম পড়েছে, রোদের যা তেজ তাতে সক্কাল সক্কাল সব কাজ সেরে বাড়ি ফেরা দায়, কিন্তু তার ওপরে যদি অশান্তির বোঝা মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়, তাহলে কী কারোর মেজাজ, মন কিছু ঠিক থাকে? ঠিক সে’রকমই ব্যাপার হয়েছে পাঁচুবাবুর সাথে। টাকমাথার, বেঁটেখাটো, মোটা জবরদস্ত গোঁফের অধিকারী পাঁচুবাবু একজন নিপাট ভদ্রলোক মানুষ; কারোর সাতে পাঁচে থাকেন না, মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে, সেই তিনিই কিনা এক ঝামেলায় পড়েছেন। তাঁর দোষের মধ্যে ওই একটাই, তিনি আম পেলেই সব ভুলে যান, মানে স্থান, কাল, পাত্র, বাড়িঘর, এমনকী নিজের দজ্জাল বউটাকেও!

তা হয়েছে কী, পাঁচুবাবু সেদিন দুপুরে পশ্চিম দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আম খাচ্ছিলেন, ঠোঁটের কোণা বেয়ে গোঁফ ছুঁয়ে সেই আমের রস গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ছিল। রমাদেবী আগেই তাঁকে সাবধান করে বলেছিলেন, “আম খাবে খাও, কিন্তু আমার কষ্ট করে মোছা মেঝেতে যদি এক ফোঁটা আমের রস দেখতে পাই, তো তোমার একদিন কী আমার একদিন, এই বলে দিলাম, হ্যাঁ।” পাঁচুবাবু ভুলো মানুষ, অতশত কী আর মনে থাকে, তাও যখন আবার আম খাচ্ছিলেন। ব্যাস্, যেই না আমের আঁটিটা শেষ বারের মত চুষে বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে যাবেন তক্ষুনি কোত্থেকে হিড়িম্বার মত এসে হাজির হলেন রমাদেবী। তারপর সে এক কাণ্ড, আশেপাশের লোকজনও শুধুমাত্র রমাদেবীরই বাজখাঁই গলার চিৎকার শুনতে পেল। ওদিকে পাঁচুবাবুর তখন করুণ অবস্থা, গুটিশুটি মেরে একধারে চুপচাপ মাথা নিচু করে কথা হজম করছেন আর অপর পক্ষের বক্তব্যের সম্মতি জানাচ্ছেন। সেদিনের শাস্তি হিসেবে ওই একটা আমই কপালে জুটল। বউয়ের বকুনি খেতে না খেতেই পাশের বাড়ির বাবলু মিত্তির বাড়ির সামনে বেরিয়ে পাঁচুবাবুকে হাঁকডাক শুরু করে দিল। দরজা খুলে আলতো হাসি হেসে মিহি গলায় “কী হয়েছে, বাবলু?” বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাবলু খেপে গিয়ে তেলে বেগুণে জ্বলে লাফ দিয়ে উঠল। বাবলু মিত্তিরের বাড়ির কাজের মেয়েটা একটা প্লাস্টিকে করে কী যেন এনে পাঁচুবাবুর পায়ের কাছে ফেলল। পাঁচুবাবু দেখতে গিয়ে দেখলেন, খাওয়া আমের খোসা, আঁটি। কাজের মেয়ে মিনতি মুখ বেঁকিয়ে বলল, “আপনি খায়ি খায়ি ফেইলবিন, আর আমাকে যোত্তসব নুংরা ছাফ করতি হবে।” রমাদেবীও ততক্ষণে গোলমালের শব্দ পেয়ে চলে এসেছেন। এইবারে আসল প্রতিপক্ষ পেয়েছেন, এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি! তারপর প্রায় পনের মিনিট ধরে বাবলু মিত্তিরের সাথে কোমর বেঁধে সেয়ানে সেয়ানে ঝগড়া চলল। বাবলু মিত্তিরও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। সেও খেঁকিয়ে বলে উঠল, “মিনতি ঝাঁট দিচ্ছিল, আমাকে ডাকতেই বারান্দায় এসে নিজের চোখে দেখলাম, পাঁচুদা আমের খোসা আমার পাঁচিলের দেওয়ালের মধ্যে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আমি কিচ্ছু বলিনি, শেষে যখন আমের আঁটিটা আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল, আমার মাথার তার এক্কেবারে কেটে গেল।” কথাগুলো শেষ করেই আবার, “অ্যাই মিনতি, বৌদির ঘরে ঢুকে প্যাকেটটা দিয়ে আয়। যাদের জিনিস তাদেরই থাকুক!” বলেই দাঁত বের ক’রে খ্যাক্ খ্যাক্ করে হাসতে লাগল। রমাদেবীও সুর সপ্তমে চড়িয়ে বলতে লাগলেন, “শোনো ভাই, বাবলু, যতক্ষণ নিজের চোখে না দেখছি কিছু বিশ্বাস করব না। আর তোমার কাছে কী প্রমাণ আছে যে তুমি ওই রকম একজন সাদাসিধে মানুষকে খামোখা দোষারোপ করে পুরো পাড়া মাথায় তুলছ?”
“কী! এত বড় কথা! প্রমাণ! এই বাবলুর কাছে প্রমাণ চাইছেন, যার মুখের কথাতে লোকে লাখ টাকা ফেলে দিয়ে যায়।”
“হ্যাঁ, চাইছি। দেখাতে পারলেই আমি নাক খত দেব, আর বাজার থেকে পাঁচ কেজি পাকা ফজলি আম কিনে তোমার বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে আসব। আমিও এক কথার মানুষ।” বাবলু প্রচণ্ড রেগে গিয়ে গোঁ গোঁ করতে করতে বাড়ি চলে গেল, সাথে মিনতিও। রমাদেবী ফ্রি কিকের মত ক’রে জোরে একটা লাথি মেরে প্যাকেটটা বাড়ির বাইরে বের করে দিলেন। আশেপাশের বাড়ি থেকে যারা ঝগড়া দেখতে এসেছিল তারা রমাদেবীকে ভয়ে বিশেষ কিছু বলতে পারে না। কিছুক্ষণ থেকে, একে তাকে ইশারায় ফিসফাস ক’রে, যে যার মত চলে গেল। রমাদেবী দরজা লাগাতে গিয়ে পাঁচুবাবুকে ওই ব্যাপারে কথা বলবেন বলে যেই পাশে তাকালেন, দেখলেন ওমা, কেউ নেই! রাগে গজরাতে গজরাতে দুম্ দাম্ আওয়াজ করে দরজা লাগিয়ে ঘরময় খুঁজতে লাগলেন পাঁচুবাবুকে। কিন্তু কোথায় কে! যাকে নিয়ে অকারণ ঝগড়া করে গলা ব্যথা করলেন, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার টিকিটি দেখতে পেলেন না। অবশ্য পাবেনই বা কী করে। তপ্ত দুপুরে দু’জনের তুমুল ঝগড়ার মধ্যে কখন যে ফাঁক গ’লে বাড়ি ছেড়ে পাড়া ছেড়ে বড় রাস্তা বরাবর হাঁটতে লেগেছেন, কেউ টেরই পায়নি। তখন তো সবাই ওই দু’জনের ঠোঁটের ওঠানামা, দাঁতের ঘর্ষণ, শব্দের হুংকার আর মুখমণ্ডলের নানা ভঙ্গিমা দেখতে ব্যস্ত।
টেবিল ফ্যানটা চালিয়ে সোফায় বসে ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করতে লাগলেন রমাদেবী, “আমি কী আর জানি না এটা কার কাজ! ওই বুড়ো আম খাবে, লোকের বাড়ি ফেলবে, নিজের তো কারোর সাথে টুঁ করার মুরোদটুকুও নেই, যত জ্বালা হয়েছে আমার। এখন গেল কোথায়?”

পাঁচুবাবুর আরো এক সমস্যা আছে তাঁর চাঁদির মত দেখতে চকচকে টাক নিয়ে। খালি মাথায় রোদে বেরোলেই, বা সূর্যের আলো ওই গোল চাঁদের ওপরে পড়লেই ভীষণ চুলকানি শুরু হয়ে যায়। তখন মাথার ওপর বরফ দিয়ে ঘষে ঘষে তবেই রেহাই। আজকে এই তপ্ত দুপুরে কোনো দিকে না তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়েছেন, ছাতা সাথে নিতে খেয়াল নেই। খেয়াল থাকবেই বা কী করে! যদিও তাঁকে নিয়েই ঝগড়ার সূত্রপাত, কিন্তু ওই ঝগড়া থেকে পালাতে পারলে বাঁচেন।
বেশ কিছুটা হাঁটার পর মাথায় হাত দিতেই বুঝলেন চুলকাতে শুরু করেছে। ঘরের ঠান্ডা আরাম ছেড়ে কারই বা এই চাঁদিফাটা রোদ্দুরে বেরাতে ভাল লাগে! নেহাতই মান-সম্মানের একটা ব্যাপার জড়িয়ে আছে তাই। পাঁচুবাবুর পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব নয়। কিছুদূর এগিয়ে গেলেই একটা আইসক্রিমের ফ্যাক্টরি। এখানে বিগত বারো বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও পাঁচুবাবুর কাছে অজানা ছিল, কিন্তু কয়েকটা আইসক্রিমের ঠেলাগাড়িকে একটা গলির সামনে থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে ওইদিকে পা চালালেন। 
গিয়ে দেখেই তো তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। ফ্যাক্টরির ভেতরে ঢুকে দেখলেন বেশ কিছু লোক কাজ করছে, সিমেন্টের বাঁধানো সব উঁচু উঁচু ব্লক যার কোনোটার মধ্যে ঠান্ডা জল, কোনোটায় আইসক্রিম বসানো হচ্ছে। আর যেটা দেখে সবথেকে খুশি ও আশ্চর্য হলেন সেটা হল, একধারে কাঁচা ও পাকা মিলিয়ে প্রচুর আম জড়ো ক’রে রাখা আছে। পাঁচুবাবু একজনকে তাঁর অসুবিধার কথা বলতেই সে এসে কয়েক টুকরো বরফ দিয়ে গেল। তারপর সেগুলো নিয়ে মাথায় ঘষে “আহ্, শান্তি” বলে হাঁফ ছাড়লেন।

কানের দু’পাশে পুরোনো দিনের সিনেমার নায়কদের মত জুলপি কাট চুল আর তাগড়াই বীরাপ্পন স্টাইলের গোঁফের ফ্যাক্টরির মালিক এসে জিজ্ঞাসা করতেই পাঁচুবাবু তাঁর চির পরিচিত স্মিত হাসি বিনিময় করে বললেন, “এই ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়েছি মশাই। তা এত আম, কিনে এনেছেন বুঝি?” 
“না না, আমার বাগানের আম। পেছনেই বাগান আছে, তাতে সব ধরণের ফল ধরে। তা এত গরমে বেরিয়েছেন যে!”
এরপর পাঁচুবাবু সেই ভদ্রলোককে তাঁর দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করে শোনালেন। লোকটি কথা বলার সময়েই বুঝতে পারছিল পাঁচুবাবুর মনের সরলতার কথা। সে বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না, এখানে দুপুরটা কাটান, বিকেলে রোদের তাপ কমলে তারপর না হয় ফিরে যাবেন।....” পাঁচুবাবুও বাধ্য বাচ্চার মত লোকটির সব কথা শুনলেন।

এদিকে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হতে চলল দেখে রমাদেবী দুশ্চিন্তায় পড়লেন। যতই ভোলাভালা হোক, নিজের একমাত্র স্বামী বলে কথা। শেষে উপায় না দেখে বাবলু মিত্তিরের দরজায় গিয়ে কলিং বেল টিপলেন কারণ অসময়ে এই বাবলুই ভাল ছেলে হয়ে গিয়ে সাহায্য করে অনেককে। বাবলুর বউ বেরিয়ে এসে ব্যাজার মুখে দরজা খুলল। রমাদেবীর কথা শুনে বাবলুরও খারাপ লাগল। যতই হোক, প্রতিবেশী তো। তাদের বিপদে-আপদে পাশে না থাকলে আর কিসের প্রতিবেশী। সে নেহাতই পাঁচুবাবু একটা আম খেয়ে ভুল করে ছুঁড়ে ফেলেছেন, কিন্তু কাঁহাতক আর রাগ করে থাকা যায়। “মানুষটা এমনিতে ভাল” এ’সব কথাই বলছিল বাবলু। “কিন্তু লোকটা গেল কোথায়? এ’রকম কর্পূরের মত উবে যাওয়ার পাবলিক তো পাঁচুদা নন” রমাদেবীকে বলল বাবলু। 

অনেকক্ষণ ধরে পাড়ার কিছু লোককে সাথে নিয়ে রমাদেবী খুঁজতে লাগলেন পাঁচুবাবুকে। একে তাকে জিজ্ঞাসা করতে করতে রাস্তায় একজন আইসক্রিমওয়ালার থেকে জানতে পেরে তারা চললেন সেই ফ্যাক্টরিতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার একজন গলা বাড়িয়ে বলল, “একবার পেছনের বাগানে গিয়ে দেখে আসতে পারেন। ওদিকে মালিকের বাগান সমেত বাড়ি।” বলামাত্রই সবাই মিলে হন্তদন্ত হয়ে বাগানে যেতেই দেখল, বাগানে আলো জ্বলছে, জনা কয়েক লোক ঘোরাফেরা করছে, আর একটা চৌকির ওপরে পরম আয়েশে ব’সে চোখ বন্ধ করে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আম খাচ্ছেন আর নিচে রাখা ঝুড়িতে আমের খোসা ফেলছেন পাঁচুবাবু। সেই আমের রস মুখ গড়িয়ে নেমে জামা ভিজিয়ে দিয়ে জামার রং করে দিয়েছে হলুদ। আর আমের গন্ধে চারপাশে ভনভন উড়ে বেড়াচ্ছে কিছু মাছি!

-সুপ্রিয়া মণ্ডল


Popular Books


Comments

  • Sandip Kumar Panda

    গল্পটি রম্যরসে ভর্তি হবার জন্য বেশ উপভোগ্য। দাম্পত্যের মিষ্টি বিবাদ ও পাঁচুবাবুর আমের প্রতি লোভ এবং আমের রস মেঝেতে পড়া নিয়ে বউয়ের বকুনি খাওয়া বেশ মজার। গল্পের বাক্যগুলি সহজ ও শব্দ গুলো সরল। আশা করি সকলের গল্পটি পড়ে ভালো লাগবে। রিভিউ সন্দীপ কুমার পণ্ডা

    Apr 30 2024
  • বিজয় লক্ষ্মী মুখার্জী

    বাঃ, বেশ মজার গল্প

    Apr 30 2024

Write a Comment