Image-Description
Stories
হিপ্ হিপ্ হুররে
Jul 10 2023 Posted by : montajpublishing

“আরে, কোথায় গেলি রে। শিগ্গির এসে আগে শোবার ঘরের জানালা গুলো বন্ধ কর। বিছানাটা পুরো ভিজে গেল! আমি কী একা হাতে সব সামলাতে পারি! সরলা, বলি এই সরলা। কানে কি তুলো গুঁজেছিস নাকি, এত করে ডেকে চলেছি কানেই যাচ্ছে না?”
“তখন থেকে শুধু সরলা আর সরলা করে চিৎকার করলে হবে? ছাদে যে এক গামলা জামা কাপড় কেচে মেলে দিয়ে এলাম, বলি সেগুলোর কী হবে? দোতলায় দৌড়ে উঠে সবকটা জামা কাপড় একসাথে তুলে আনা কী মুখের কথা? দেখ তো, ঠিকমতো দম নিতে পারছিনা! পুরো ভিজে একেবারে স্নান করে গেলাম। আর তুমি বিছানা ভিজে যাওয়ার কথা বলছ? এখন বৃষ্টির জলে ভিজে যদি আমার জ্বর আসে তবে আমার সেবাটা কে করবে শুনি?কামাই করলেই তো বলবে যে ইচ্ছে করে ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি! সকালেই তোমাকে পইপই করে বললুম যে বৌদি গো, আজকে আর জামা কাপড় ভিজিও না! বর্ষাকাল, সকাল থেকেই তো বোঝা যাচ্ছিল চুটিয়ে বৃষ্টি নামবে। কিন্তু তুমি শুনলে না তো সে কথা। ছুটির দিন, তোমাকে তো একরাশ কাপড় জামা কেচে পরিস্কার করার জন‍্যে ভেজাতেই হবে। আর আমাকেও পেয়েছ একখানা কলুর বলদ। জানো মুখে গজগজ করলেও তোমার কথা ফেলতে পারব না। এখন এই এত্ত গুলো ভিজে জামা কাপড় নিংড়ে কোথায় মেলি বলো তো?”
“আরে দেখছিসই তো বাড়িতে কেউ নেই। থাকার মধ‍্যে এখন শুধু আমি আর তুই। কে কোন দিকে ছুটি বল?ছেলেটাকে বারবার করে বললাম যে, আজকে স্কুল ছুটি আছে, আর ঘন্টা খানেক না হয় একটু বেশিই পড়াশোনা করলি। ক্লাস নাইনে উঠেছে। লেখাপড়ার কম চাপ? কিন্তু কে শোনে কার কথা! শুনলে তো বাবা-মা’দেরকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে আর ভাবতেই হত না।“

“আচ্ছা বৌদি তুমি নিজের বুকে হাত দিয়ে একটা সত‍্যি কথা বল তো যে, টুকাই বাবুর বয়সে দিনে তুমি ক’ঘন্টা পড়াশুনা করতে? সবে তো চোদ্দো পেরিয়ে পনেরো। গত মাসেই চোদ্দোটা মোমবাতি নিভিয়ে কেক কেটে জন্মদিন পালন হল। তো এই বয়সে একটু ছেলেমানুষী করবেনা, চঞ্চলতা করবেনা? সারাদিন মুখে বই গুঁজে ঘরে বসে থাকবে?”
“তুই থাম তো। মায়ের থেকে দেখছি মাসির দরদ বেশি উথলে উঠছে। লেখাপড়ায় ভালো রেজাল্ট না করলে তারপরে তো সারাজীবন পরের গোলামী করতে হবে। সেটা কি বেশি সুখের? আমাদের মেয়েদের কথা ছাড়, বিয়ের বয়স হলে ঠিক একটা না একটা বর জুটে যাবে। রোজগার তো আর করতে হচ্ছেনা। আর পুরুষ মানুষকে শুধু নিজের পেটই নয় উল্টে সংসার পাতলে স্ত্রী-সন্তান সবারই খাওয়া-পরার দায়িত্ব নিতে হবে। তো রোজগার করতে গেলে পেটে কিছু বিদ‍্যা-বুদ্ধি থাকাটা তো দরকার,নাকি?”
“সেটা আসলে তোমরা ঐভাবেই ভেবে অভ‍্যস্থ,তাই। আমাদের শ‍্যামার বাবাতো বড় জোর ফাইভ পাশ। কিন্তু কোন কাজটা পারেনা বলো? জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব জানে। কিন্তু হ্যাঁ, কাজের বড়ই অভাব। তাই যখন যেটা পায় সেটাই করে। দৈনিক কাজ পেলে কী আমাকে এইভাবে লোকের বাড়িতে গতর খাটিয়ে রোজগার করতে হতো বল তো।“
“আরে সেই জায়গাটাই তো তোকে তখন থেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে সবজান্তা না হয়ে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়। আর তার জন‍্যে লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই। ছোটবেলায় পনের বছর কষ্ট করে একটু ঠিকমতো পড়াশোনাটা করে নে, তারপরে বাকি জীবনটা পায়ের উপর পা তুলে আয়েস কর। নে, অনেক হয়েছে। এখন এসব নিয়ে জ্ঞান বিতরণ করলে আর দুপুরের খাওয়া জুটবেনা। সবেমাত্র ভাত আর ডাল হয়েছে। কত রান্না এখনো বাকি! চল চল চটপট করে সবজিগুলো কুটে দে। ভিজে জামা কাপড় গুলো নিয়ে পরে ভাবা যাবে। বৃষ্টি তো আর গোটা দিন ধরে হবে না।এদিকে বৃষ্টিও তো থামবার নামই নিচ্ছে না। ছেলেটা যে কোথায় গেল। এরপরে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে এসে জ্বর,সর্দি বাধাবে আর তোর দাদার কাছে বকা খেতে হবে আমাকে। আমার হয়েছে যত জ্বালা। আমার আস্কারা পেয়ে পেয়ে ছেলেটা নাকি দিনকে দিন বাঁদর হয়ে যাচ্ছে। আমি কী এমনি এমনি এত কথা বলি? মনের দুঃখ থেকেই বলি। আর তুই ভাবিস বৌদি বেশি কথা বলে!“

        **       **

“আরে টুকাইদা, বলটা এদিকে পাস কর!“
“আরে করব কী করে। বল তো এগোচ্ছেই না, জলে আটকে যাচ্ছে।“
“একটু আঙুলের ডগা দিয়ে তুলে নিয়ে শট মার।“
“আরে সেটাই তো তখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু যা পিছল, ঠিক মতো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই তো পারছিনা, বল মারা তো দূরের কথা!"
“ঠিকই বলেছিস। তবে বৃষ্টিটা কিন্তু হেব্বি হচ্ছে, তাই না! দৌড়াচ্ছি, পড়ে যাচ্ছি কিন্তু একটুও ঘাম হচ্ছে না।“
“আর পড়ে গেলে ব্যথাও লাগছে না। কেটে ছড়ে যাওয়া তো দূরের কথা।“
“যা বলেছিস, উপরে জল নিচে জল আর মাঝখানে আমাদের পায়ে বল। বাড়ি থেকে আসার সময় অপুটাকে কতো করে ডাকলাম। বলে কী “না রে, কালকে স্কুলে অঙ্ক স‍্যার ক্লাস টেস্ট নেবে। না পারলে গার্জেন কল হয়ে যাবো” ― ন‍্যাকা!! পড়িস তো ঐ সেভেনে, তাতেই এই !! এইসব ছেলে-পুলে জীবনে বেশি দূর এগোতে পারবেনা, মিলিয়ে নিস।“
“সবই তো ঠিক আছে কিন্তু ভেবে দেখ, আমাদের মায়েরা যদি আমাদেরকে এইভাবে কাদা-মাখা অবস্থায় ভিজে দাঁড়কাকের মতো দেখতে পেত তাহলে নির্ঘাৎ হার্টফেল করতপ। বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে দশ মিনিটের যায়গায় এগারো মিনিট হয়ে গেলেই চেল্লামেল্লি শুরু। শিগ্গির বেরিয়ে আয়, ঠান্ডা লেগে যাবে। বুকে সর্দি বসে নিমোনিয়া হয়ে যাবে। আরও কত কী!“
“সত‍্যি, যা বলেছিস!! একমাত্র মায়েরাই এমনটা পারে। পান থেকে চুন খসলেই চিৎকারের চোটে বাড়ি মাথায় করে ফেলবে। আর আমার দিদি তো একেবারে ওৎ পেতে বসে থাকে। মা যত না বলবে দিদি তার থেকে দশ গুণ বেশি। মায়ের মাথাটাকে একেবারে চিবিয়ে খেয়ে নেবে!" ― দেখেছ তো, ভাই বলে আজকে কিছু বললে না। ভাইয়ের জায়গায় আমি হলে এতক্ষণে পিঠে দু-ঘা পড়ে যেত।“ ― এমনিতেই বকা খাচ্ছি, তার উপরে গরম তেলে ফোড়ন ছিটোচ্ছে, ভাব একবার। কাহাতক সহ‍্য করা যায়? দে দুমাদুম কষিয়ে কটা কিল চড়,ঘুসি। আর তারপরে যা হবার তাই, বাড়ির সবারই দুপুরের খাওয়ার চোদ্দটা।"
“তোর দিদি তোর থেকে বয়সে দু-বছরের বড় না? আমার একটা দিদি থাকলে কি ভালো হতো বলত। মাঝে মধ‍্যে সবকিছুর উপরেই খুব রাগ হয়। কোনকিছু স্বাধীন ভাবে ভাববার উপায় নেই !! যা বলি সবই নাকি ভুল। আমার বুদ্ধি নাকি এখনো পাকেনি, তাই বড়দের মুখে মুখে তর্ক না করে বড়রা যা বলছেন সব কান খুলে মন দিয়ে শোনো। রাগ হলে সেই রাগটা যে তোর মতো কাউকে দু-ঘা দিয়ে মনের জ্বালা মিটিয়ে নেব, তার উপায় নেই। তোর কি ভালো বল। রাগ হলো, ব‍্যাস, দিদিকে দু-চারটে দিয়ে মনের জ্বালা মিটিয়ে নিলি।“
“নারে টুকাইদা। তুই যেভাবে ভাবছিস ব‍্যাপারটা ঠিক সেটাও নয়। মার খেয়ে দিদি যখন হাপুস নয়নে কাঁদে, দেখে খুব কষ্ট হয় রে। আসলে হঠাৎ করে রেগে গেলে তখন মাথার ঠিক থাকেনা। পরে মনে হয় এত জোরে না মারলেই পারতাম। নিশ্চয়ই খুব ব‍্যথা পেয়েছে। দিদির পিঠে গিয়ে হাত বুলিয়ে দি। দিদি খুশি হয়। কান্না বন্ধ করে শুধু বলে, “তোর শরীরে একটুও মায়া দয়া নেই? এত জোরে নিজের দিদিকে কেউ মারে? আমার ব‍্যথা লাগেনা বুঝি?” আমি উত্তরে বলি,”তুইই-বা মায়ের সাথে জুড়ে পাল্লা দিস কেন? দেখছিস তো মা ভীষন রেগে গেছে। তার উপরে কেউ যদি মাকে আরও উত্তেজিত করে দেয় তাহলে তো মা আমাকেই ধরে উত্তম মধ‍্যম দেওয়া শুরু করবে। তাহলে তুই কি চাস যে, মায়ের হাতে আমি উঠতে বসতে মার খাই?” দিদি এরপরে চুপ করে যায়, আর কিছু বলেনা।“
“কিন্তু এবার বাড়ি ফিরতে হবে রে! মনে হচ্ছে বেলা ভালোই হয়েছে, মেঘলা বলে সময়টা বোঝা যাচ্ছে না।“
“ঠিকই বলেছিস। কিন্তু এইভাবে কাদা-মাটি মেখে বাড়িতে ফিরলে তো বাড়িতে ঢুকতেই দেবেনা।“
“বাড়িতে ঢুকতে দেবে, কিন্তু তারপরে গরম জলে চুবিয়ে সাবান সোডা দিয়ে মা, যা ঘষবে মনে হবে দশদিনের পুরোনো, রান্না করে ফেলে রাখা না ধোওয়া বাসনের গা থেকে পোড়া দাগ তুলছে। শরীরের ছাল-চামড়ার দফারফা। মা মনে করে মাঠের জল কাঁদা গায়ে লাগা মানেই চামড়ায় নির্ঘাৎ খোস পাঁচড়া বের হবে।“
“চল টুকাইদা, মনীশ জেঠুদের পুকুরে চারটে ডুব দিয়ে গায়ের কাদা ধুয়ে সাফ করে ফেলি। এই সুযোগে বার দুয়েক একটু এপার ওপার সাঁতার কম্পিটিশনটাও করে নেওয়া যাবে। তোর সাথে আমি অবশ‍্য পারব না। কিন্তু লড়ে দেখতে ক্ষতি কী?”
“বেড়ে বলেছিস তো। পড়িস তো ক্লাস এইট-এ, এত বুদ্ধি আসে কোথা থেকে? আমার সঙ্গে থেকে থেকে তোরও দেখছি আমার হাওয়া লেগে গেছে।"
“আরে কার শিষ্য দেখতে হবে তো। দ‍্য গ্রেট টুকাই দাদা। হিপ্ হিপ্ হুররে !!”

মৃণাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়


Popular Books


Comments

Write a Comment