Image-Description
Stories
রাঙা হাসি
Mar 20 2024 Posted by : montajpublishing

ঘরে ঢুকে সুতপা দেখল মাথা অবধি চাদরে ঢেকে দিয়ে টুবলু শুয়ে আছে। লাইট জ্বালিয়ে খাটের কাছে এসে বলল, "সন্ধে হয়ে গেছে, আর ঘুমোয় না..."
ছেলে নড়াচড়া করছে না দেখে খাটে বসে মাথা থেকে চাদরটা সরিয়ে বলে,"এই দ্যাখ কেশর ফ্লেভারের কমপ্ল্যান করে এনেছি। উঠে পড় বাবা।"

মায়ের ডাকে পিটপিট করে চোখ মেলে আড়মোড়া ভেঙে ছোট্ট হাই তুলে উঠে বসে টুবলু জিজ্ঞেস করে, "টমি কোথায় মা? ওকে কিছু খেতে দিয়েছ?"
"জেম্মার ঘরের মেঝেতে বসে দুধ-বিস্কুট খাচ্ছে।"

"তুমি ওর খাবারটা নিয়ে এসে ওকে এঘরে ডাকো, আমরা একসাথে খাব।"

"আচ্ছা ডাকছি, তু্ই চোখ মুখ ধুয়ে আয়।"

খাট থেকে নেমে যেতে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়তেই একটু এগিয়ে দেখল গলায়- হাতে- গালে লাল রঙের হালকা ছোপ রয়ে গেছে। মাকে বলে,"একি! সব রঙ তো পরিষ্কার হয়নি! তুমি আমার সঙ্গে বাথরুমে চলো, সাবান দিয়ে ঘষে উঠিয়ে দেবে।"

 হাতে ধরা কমপ্ল্যান ভর্তি গ্লাসটা পড়ার টেবিলে রেখে সুতপা উঠে ছেলের কাছে এসে বলল,"সন্ধেবেলা সাবান মেখে জল ঘাঁটলে ঠান্ডা লেগে যাবে। কয়েক দিন চান করার সময় সাবান মাখলে রঙ পরিষ্কার হয়ে যাবে।"

"তুমি তো জানো মা রঙে আমি ভয় পাই, এই রঙ গায়ে থাকলে যে..."

রঙের প্রতি ছেলের কেন ভয় ধরে গেছে, সুতপা বোঝে। এখন ও ক্লাস ফোরে পড়ছে, এবার ভীতিটা কাটানো দরকার বুঝে সুতপা বোঝাল,
"ধুর বোকা, রঙে ভয় কীসের? বছরে একবার রঙ খেলা ভাল। বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-চৈ করে কী মজা হয়, জানিস..."

দুঃখ-দুঃখ স্বরে টুবলু বলে,
"আমায় কেউ বন্ধু করে না। টমি আমার একমাত্র বন্ধু।"

"এমনি এমনি কেউ কারোও বন্ধু হয়! সমবয়সীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে হয়। এবার থেকে বিকেলে মাঠে গিয়ে পাড়ার ছোটোদের সঙ্গে খেলবি।"

"আমি তো বন্ধু হতে চাই; ওদের সঙ্গে খেলতেও চাই, কিন্তু ওই দুষ্টু ছেলেগুলো আমায় দেখলে হাসাহাসি করে, ওদের মতো দৌড়ে গিয়ে  লুফে বল ধরতে পারি না, ব্যাটে জোরসে বল মেরে ছুটে গিয়ে রান করতে পারি না, সেজন্য আমাকে ওরা দলে নেয় না, বাজে বাজে কথা বলে।"

"আমি ওদের মায়ের সঙ্গে কথা বলব। তু্ই যা, কমপ্ল্যানটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে..."


  ওর বাবা অনুজ আর্মিতে চাকরি করত। সীমান্তে শত্রু-সৈনিকদের সঙ্গে লড়াইয়ে মারা যায়। সে'সময় অনুজের পোস্টিং ছিল পাঠানকোটে। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে মিলিটারি কোয়াটার্সে থাকত। মৃত্যুর খবরটা পরিবারকে জানানোর পর স্বামীর শোকে সুতপা খুব ভেঙে পড়ে। সাত বছরের টুবলু কান্নাকাটি করলে, ওকে সামলাতে পারছিল না। সেই পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীর দু'জন অফিসারের দায়িত্বে কফিন বন্দি অনুজের দেহটা প্লেনে করে রায়গঞ্জের বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে পোষ্য টমি আর ছেলেকে নিয়ে সুতপা ফিরে এসেছিল। ওখানে ওর শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন।

   ছোটোছেলেকে শেষবারের মতো দেখতে চাওয়ায় কফিনের ঢাকনা খোলা হয়। মায়ের সঙ্গে টুবলু অদূরে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ একঝলক হাওয়ায় চাদরের কিছুটা খুলে যেতে টুবলু দেখল চাপ চাপ রক্তে বাবার ইউনিফর্মটা লাল হয়ে গেছে। অপলক চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দু'হাতে চোখ ঢেকে মায়ের শাড়িতে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে ওঠে। অতটুকু বয়সে ওই দৃশ্য টুবলুর কচি মনে লাল রঙে ভীতি জন্মায়। ঠাম্মার কপালে বড় লাল টিপ, গাঁয়ে লাল ব্লাউজ দেখে চোখ বুজিয়ে নিত। অনেক বুঝিয়েও ছেলেকে লাল রঙের জামা পরাতে পারত না, এমনকি লাল রঙে খেলনা গাড়ি গুলো চোখের সামনে থেকে সরিয়ে রাখে।

 বছর খানেক ওরা দাদুর বাড়িতে ছিল। অনুজের দাদা অনুপ শহরে নিজের দোতলা বাড়ি করে স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে বসবাস করছেন। ভাইয়ের ছেলেকে ভাল স্কুলে ভর্তি করার জন্য ওদের এখানে নিয়ে আসেন। ভাসুরের চেনার সূত্রে প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়ে যায় সুতপা। জেঠতুতো দাদা দিদির সঙ্গে সহজে ভাব করে নেয়। কিন্তু অচেনা কারও সঙ্গে চট করে মিশতে পারে না। জন্ম থেকে ওর বাঁহাতের কব্জিটা বেঁকা আর ডান পা'টা একটু ছোট। এই প্রতিবন্ধকতার জন্যই হয়তো নিজেকে গুটিয়ে রাখে। নতুন জায়গায় এসে স্কুল আর আঁকার ক্লাসে যাওয়া বাদে বাকি সময়টা টমিকে নিয়ে খেলে। জেম্মার বলাতে দু'-তিনদিন মাঠে খেলতে গেছিল, কিন্তু পাড়ার ছেলেদের অমন ব্যবহারে মন খারাপ করে বাড়ি চলে এসেছিল।

দোলের দিন দুই আগে ছেলেকে নিয়ে সুতপা দোকানে গেছিল। ফেরার সময় দুষ্টু ছেলেদের একজন বলে, "আমরা পাড়ার ছোটরা মিলে রঙ খেলি। এবারে তু্ই আমাদের সঙ্গে খেলবি।"

 টুবলু বলল,"আমি রঙ খেলি না।"

যে রঙ খেলে না, তাকে রঙ মাখিয়ে ভূত করে অনেকেই মজা দেখে। এই ছেলের দল তেমনই দুষ্টু বুদ্ধি আঁটে।

 দোলের দিন সকালে পুরোহিত মশাই এসে নারায়ণ পুজো করে গেছেন। টুবলুর দাদা-দিদি পাড়ার মোড়ে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রঙ খেলছে। জেম্মার হাতে মাখা সিন্নি খেয়ে বাড়ির পেছনের বাগানে গিয়ে জাম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে টমির সঙ্গে কিছুক্ষণ বল খেলল। বাগানের চায়না টগর ফুল গুলো ওর খুব প্ৰিয়। কী সুন্দর মিষ্টি গন্ধ! জেঠুর যখন বাগানে এসে গাছেদের পরিচর্যা করে, সেও তখন জেঠুর সঙ্গে থেকে গাছেদের যত্ন করা শেখে।

 বাগানে এসে টমি ছুটোছুটি করে আপন মনে খেলে। গলায় বাঁধা চেনটা ছেড়ে টমিকে মুক্ত করে টগর গাছটার কাছে গিয়ে শুকনো ডাল,পাতা কুড়িয়ে গাছের তলাটা পরিষ্কার করতে লাগল টুবলু। নিচু পাঁচিল দিয়ে অর্ধ-গোলাকারে বাগানটা ঘেরা। ডানপিটে ছেলেদের পক্ষে পাঁচিল ডিঙিয়ে আসা তেমন শক্ত নয়। টমিকে নিয়ে খেলার সময় দুষ্টু ছেলের দল টুবলুর গলা পেয়ে বুঝেছে সে বাগানে একা আছে। কখন সে পাঁচিলের এ'ধারে আসবে, সেই অপেক্ষায় ওরা ঘাপটি মেরে ছিল। ওদের দলে বান্টি দুষ্টু বুদ্ধিতে সবচেয়ে ওস্তাদ। টুবলুকে নাকাল করার ফন্দিটা ওর মাথা থেকেই বেরিয়েছে, তাতে অন্যরা সায় দিয়েছে।

  টুবলু ঝুঁকে পাতা গুলো কুড়োচ্ছে, এই সুযোগে আরেকটি ছেলে চাঙ্কু পাঁচিলে উঠে দাঁড়ালে লাল রঙ গোলা বালতিটা ওর হাতে ধরিয়ে বান্টি চোখের ইশারা করতে ডানদিক-বাঁদিক দেখে নিয়ে বালতি ভর্তি রঙের গোলা টুবলুর পিঠের দিকে ছুঁড়ে দেয়। আচমকা হুড়মুড় করে এত্ত জল এসে পড়ায় টুবলু মুখ থুবড়ে গাছের গোড়ায় পড়েই যাচ্ছিল, কোনওমতে সামলায়। মাথা থেকে পা অবধি রঙিন জলে ভিজে জবজব করছে। টপটপ করে জল ঝরা দেখে ওর মনে হল যেন রক্তের ধারা ঝরছে! বিষম ভয়ে থরথর করে কেঁপে ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। টমি গিয়ে সুতপাকে ডেকে আনলে দেখল ভয়ে কুঁকড়ে টুবলু হাউহাউ করে কাঁদছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে এসে তখুনি সাবান মাখিয়ে চান করিয়ে দেয়। টুবলুর কান্না থামছে না দেখে বড়-জা'র কথায় সুতপা ছেলেকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে শান্ত করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। জিজ্ঞেস না করেও সে বুঝতে পারে এই কান্ড দুষ্টু ছেলের দলেরই ঘটানো।

ভাইকে কাঁদিয়েছে শুনে টুবলুর দাদা-দিদিরা দুষ্টু ছেলে গুলোর বাড়ি গিয়ে তাদের বাবা-মাকে সকালের ঘটনাটা বলে এসেছে। টুবলুকে বলেছে, ওদের বাবা-মা খুব বকে দেবে যাতে ওরা আর কখনও এরকম বদমাইশি না করে।

 সন্ধেবেলা একতলায় বসার ঘরে বসে মুড়ি-মুড়কির সাথে ফুটকড়াই খাচ্ছিল। এমন সময় বান্টি, চাঙ্কু আরও তিনজন ছেলেকে নিয়ে ওদের বাবা-মা অনুপদের বাড়িতে এল। বাবা-মা বোঝানোতে ওরা বুঝেছে রঙ খেলায় মজা করতে গিয়ে ওরা অন্যায় করে ফেলেছে। সুতপা আন্দাজ করতে পারল ওদের আসার উদ্দেশ্য। তাই টুবলুকে বলল, "বন্ধুরা এসেছে, যা কথা বল।"

মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দু'পা এগোতে বান্টিরা ওকে ঘিয়ে দাঁড়িয়ে একসাথে বলল,
"আমরা জানতাম না তু্ই রঙে ভয় পাস, বাবা বলেছে জোর করে কাউকে রঙ মাখানো উচিত নয়। সকালে ওভাবে তোর গায়ে রঙ ছুঁড়ে দেওয়াটা...খুব ভুল হয়ে গেছে রে ভাই। প্লিজ তু্ই দুঃখ পাস না।"

  টুবলুর হাতের ওপর পাঁচটা হাত রেখে একসাথে বলল, "আজ থেকে তু্ই আমাদের বন্ধু হলি।"

চাঙ্কুর মা বলল,"শুনেছি তু্মি লাল রঙে ভয় পাও, তাই রঙ তো ভাল জিনিস, একটু রঙ খেললে মনও ভাল থাকে। তাছাড়া লাল রঙের জামা পরলে ছোটদের খুব ভাল লাগে।"

 জেঠিমা যোগ করল, "আমিও সেকথা বোঝাই ওকে।" তারপর মাটির থালায় কিছুটা লাল আবির এনে বলল, "নে বন্ধুদের গালে একটু মাখিয়ে দে।"

 এক মুহূর্ত চোখ বুজে থাকল টুবলু। তারপর আলতো হেসে আঙুলে একটু আবির তুলে বন্ধুদের মাখিয়ে দিল। সবাই সবাইকে আবির মাখাল।

এবার বান্টির মা সুতপাকে বলল, "আজকে রাতের আমাদের বাড়িতে ছেলের বন্ধুদের নেমন্তন্ন। ওদের পছন্দসই সব রান্না করেছি।একটু পরে টুবলুকে পাঠিয়ে দিও। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ- মজা করে রাতের খাওয়া সেরে ফিরবে।"

ওরা চলে গেলে মায়ের গলা জড়িয়ে টুবলু আবদার করল, "আমায় একটা নতুন লাল জামা কিনে দিও।"

 স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুতপা বুঝল, বন্ধুত্বের নির্মল বন্ধনের ডোর রঙের ভীতি একবারে মুছে দিল।

          সমাপ্ত

-শাশ্বতী মুন্সী 


Popular Books


Comments

  • সুজয় সাহা

    ভালো

    Mar 20 2024

Write a Comment