Image-Description
Stories
বন্ধু
Mar 19 2024 Posted by : montajpublishing

এ বছর দোল-পূর্ণিমা অনেক দেরি করে এল। দোল আসতে আসতে মার্চের শেষ প্রায়, আর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই ফার্স্ট-টার্মের পরীক্ষা। ক্লাস ফোরে বিজুর রেজাল্ট একেবারেই ভালো হয়নি। ওভারঅল গ্রেড ‘বি’। তার-উপর সবে জ্বর থেকে উঠেছে সে। তাই এ বছরের জন্য দোল-খেলা তার নিষেধ। তখন বিজু বুঝতে পারেনি এতটা মন-খারাপ হবে। সবার কথায় সায় দিয়ে সে নিজেও বলেছিল—“এ বছর আর রঙ খেলতে বেরোব না।”
সেদিন সকাল থেকে বিষণ্ণ মুখে বসে থেকেছে বিজু। পড়তে তার ইচ্ছে করছে না মোটেই। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখেছে পাড়ার বন্ধুরা সব দল বেঁধে বেরিয়েছে। ওর বাড়ির সামনে এসে ডাকাডাকি শুরু করতে ও উঠে যাওয়ার আগেই বাবা গিয়ে তাদের বলে দিলেন—“বিজু যাবে না রে বাবা! তোরা খেল!”
সামনে-খুলে-রাখা-বইয়ের পাতায় মন দেওয়ার চেষ্টা করেও আর হয়ে ওঠে না… বাবা ঘরের সামনে থেকে সরে গেলেই এক ফাঁকে টুক করে উঠে সোজা ছাদে চলে যায় বিজু। ছাদ থেকে দেখতে পায়—রিয়া, মানস, বিউটি, কহিম আর লীলাদের দলটা রঙ মেখে ভূত হয়ে পিচকারি হাতে নিয়ে মালির বাগানের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। এরা বিজুর বেস্ট ফ্রেন্ড(স)। এদিক-ওদিক আরও কত রঙ মাখা মানুষের দল!
“কই! ওদের তো পড়ার ক্ষতি হয় না! জ্বর তো সেরেই গেছে! আবার কেন জ্বর হবে আমার!” নিজের মনে বলতে বলতেই বসে পড়ে বিজু, কারণ অন্যদিক থেকে মতি ইতিমধ্যেই ওকে দেখতে পেয়ে ডাকতে শুরু করেছে, বাবা-মা’র কানে গেলে হয়ে যাবে তার ছাদে আসা! চোখের কোণ বেয়ে এক-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ওর—
বাজে রেজাল্ট হয়েছে? গ্রেড ‘বি’? হলই বা! ‘এ’-এর পরে ‘বি’, ‘বি’-এর পরে ‘সি’, ‘সি’-এর পরে ‘ডি’ ― সবসময় ‘এ’-ই কেন পেতে হবে তাকে! ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ ‘ডি’…সবগুলোই তো লেটার! ছাদের এক কোণে বসে বসে দু-হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে নিজের মনে এলোমেলো ভাবছিল বিজু। এক-একবছর দোলের দিন মামা-বাড়ি যাওয়া হয়। এই আগের বছরেই গিয়েছিল ওরা। কুঞ্জনগর গ্রামে বিজুর মামার-বাড়ি। সেখানে খুব মজা! বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো পুকুর আছে সেই গ্রামে, পুকুরে স্নান করার অভ্যেসটাও আছে এখনও অনেকের। আর বিশেষ ক’রে এই দোলের দিন, বিজুর মতো যে সাঁতার জানে না, সেও নেমে যায় পুকুরের হাঁটু-জলে।
চোখের জলে চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসে ওর। আর সেই জায়গায় ফুটে উঠতে থাকে আগের আগের বছরগুলোতে মামা-বাড়ির দোল-খেলার ছবি, মানুষ-বন্ধু নয় সেখানে শুধু; রঙ খেলার সাথী আরও কত-রকমের ― যাদের খেলার ইচ্ছে হলেও মুখে সেই কথা বলতে পারে না ― কুঞ্জনগরের ঘাটে জল খেতে আসে ছাগল, গরু আর মোষের দল। তারাও রঙ মাখে। তবে তাদের গায়ে আবির ছাড়া অন্য কিছু দিতে নিষেধ আছে। সাদা সাদা গরুর পাল যখন আবির মেখে নেমে যায় পুকুরের জলে স্নান করতে, পুকুরের জলে ওঠে রঙের হিল্লোল—যে একবার দেখবে তার আর সে-কথা ভোলার মতো নয়! বিজুও দেখেছে। নাহ, এ বছরে রেজাল্ট আর কিছুতেই সে খারাপ করবে না।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অনেকটা দেরি হয়ে গেল, কখন যে ঘড়ির কাঁটায় বারোটা বেজে গেছে কে জানত! মা নীচে থেকে ডাক পাড়ছেন—
“বিজু, স্নানে যাও!”
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বিজু—স্নানে গিয়েই বা কী হবে! রঙ আছে নাকি ওর গায়ে!
ঠিক এমন সময় বাড়ির পাশের কুকুরগুলো চিল-চিৎকার জুড়ল। কী হল রে বাবা! ভর-দুপুরে ডাকাত নাকি! কুকুরগুলো সাধারণত এমনি ক’রে চেঁচায় না, যদি না ওদের মধ্যে বিশেষ কোনো সমস্যা হয়; অবশ্য অপরিচিত সন্দেহজনক মানুষজন দেখলেও এমনি করে ওরা। আর এই দোলের দিন তো চেনা মানুষকেও অচেনা লাগে, মানুষ তো নয়, যেন ভূত লাগে এক-একটা!
সারা পাড়ার কুকুর এক জায়গায় জড়ো হয়ে গেছে মনে হয়। সব একসাথে হয়ে চিৎকার জুড়েছে ঠিক বিজুদের বাড়ির সামনে।
রঙ-মাখা-ভূতগুলো সব বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল। যেতে যেতে তারাও আবার ফিরে আসছে ব্যাপার দেখতে। ব্যাপার আর কিছুই না, একটা নতুন অন্য পাড়ার কুকুর কোনোভাবে এই রাস্তায় এসে পড়ায় পাড়ার সব কুকুররা মিলে তাকে খেদাচ্ছে।
বিজু নীচে তাকিয়ে ঘটনাটা দেখে নিয়েছে আগেই। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে নেমে এসে খোলা দরজা দিয়ে সে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। মা আর বাবাও দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানেই। পাড়ার কয়েকজন কাকু, দাদা আর বিজুর বাবা লাঠি হাতে কুকুরগুলোকে শান্ত করছেন। বিপদ নেই বুঝে গিয়ে ওরাও মোটামুটি চুপ করেছে, শুধু দু-একটার গলায় চাপা গর্জন তখনও!
অবেলায় রঙ-খেলাটা আবার একটু জমল। পিচকারি হাতে তাক ক’রেই ছিল মতি। বিজুকে দেখামাত্রই জল-বন্দুকের অব্যর্থ নিশানা। বিজু যদিও অপ্রস্তুত এসেছিল, কিন্তু দোলের দিন কি আর রঙের অভাব হয়! ওদের থেকে রঙ নিয়েই ওদের মাখাল বিজু। নাহ, দিনটা শেষমেশ বৃথা গেল না তাহলে!
বিজুদের বাড়ির ঠিক সামনেটায় একটা খেলার মাঠ, মাঠের দিকে মুখ ক’রে দাঁড়ালে বাঁ-হাতে পড়ে একটা পানা-পুকুর। ভয় পেয়ে পানা-পুকুরের দিকে সরে গিয়েছিল যে অনাহুত অতিথি, সে এখন সময় বুঝে টুকটুক-পায়ে হেঁটে আসছে আবার!
লালচে-সাদা লোমগুলো আলোর মতো ঝিলমিল করছে রোদে।
আরে! এ তো ডেক! সেই কুকুরটা! কুঞ্জনগরে ওর বাড়ি। কারো পোষা নয় ওরা, রাস্তারই কুকুর। যে যা খেতে দেয় খায়, না দিলে এখান-ওখানে পড়ে থাকা খাবার খুঁজে খায়। আর অকারণেই সোজা রাস্তা ধ’রে ছোটে। ক্লান্ত লাগলে ঘুমিয়ে নেয় একটু মাটিতে শুয়েই। যারা ভালোবাসে আর মাঝেমাঝে খেতে দেয়, তাদের দেখলে লেজ নেড়ে নেড়ে কাছে যায়। এই এ-পাড়ার কুকুরগুলোর মতোই। আগের বছর দোলের দিন ওকেও রঙ মাখিয়েছিল বিজু। পিচকারির বাজে রঙ। সেই নীল-সবুজ ছোপ ছোপ দাগ এখনও হালকা হালকা রয়ে গেছে ওর লোমে। অঞ্জুমাসির কাছে কী বকাটাই না খেতে হয়েছিল সেদিন! “এসব কী রে বিজু! কুকুরকে কেউ এসব বাজে রঙ মাখায়! সবাই জানতে পারলে কী হবে জানিস তোর!”
সত্যি খুব ভুল হয়ে গিয়েছিল বিজুর। ও ভেবেছিল নিষেধটা শুধু গোরু-ছাগলের ক্ষেত্রেই। কিন্তু মানুষ ছাড়া কাউকেই যে বাঁদরমুখী রঙ দিতে নেই, আর কুকুরকে আবির ছেটানোও নিষেধ কারণ ওরা ধুলো ভয় পায়, আবির ওদের চোখে ঢুকে যেতে পারে, এই ব্যাপারটা বিজু জানত না। জানার পরে ও গিয়ে ওদের ‘সরি’ বলেছিল অবশ্য, ডেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল পুকুরঘাটে। কিন্তু ওরা জলে নামতে চায়নি। বিজু আর কী করবে! ওরা যে রাগ করেছে, সেটা কিন্তু একেবারেই মনে হয়নি। লেজ নেড়ে নেড়ে মুখে সেই ‘কুঁই-কুঁই’ শব্দটা করছিল, যেটা খুব খুশি হলে করে। ওই দলেরই একজন এই ‘ডেক’। কারও পোষা না হলেও নাম ওদের আছে।
বিজুকে হাসি হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ডেক নির্ভয়ে লেজ নাচিয়ে নাচিয়ে আসতে থাকল। ওকে দেখতে পেয়ে বাকি কুকুররা আর এক প্রস্থ শুরু করতে যাচ্ছিল আবার। পিকুদাদা হাতের লাঠিটা মাটি থেকে ফুটখানেক উপরে তুলে ধরতেই আবার সব চুপ। ডেককে ডেকে নিয়ে গিয়ে বিজু মাকে বলে রান্নাঘর থেকে অনেকটা ভাত আর খানিকটা তরকারি নিয়ে এল। উঠোনের এক কোণে শিউলিগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে মাটির বাসনে ভাত খেল ডেক। ওকে পেয়ে মা-বাবাও খুশি! দোলের দিনের অতিথি বলে কথা! হলই বা সে না-মানুষ!
ডেককে ওর নিজের গ্রামে পৌঁছে দিতে বিকালের দিকে সবাই মিলে কুঞ্জনগর যাওয়া হবে, নাকি আপাতত ওকে রেখে দেওয়া হবে এই বাড়িতেই, সেই নিয়ে বাবা-মা’র মধ্যে আলোচনা চলছিল। দু’টো ব্যবস্থার যেটাই হোক, দু’টোতেই বিজু খুশি। আলোচনার কোনো কিনারা হল না, এদিকে বেলা বয়ে যাচ্ছে। মা ডাক দিলেন— “নাইতে হবে তো, অনেক বেলা হল!”
ডাকতে এসে মা দেখলেন—শিউলিতলায় ডেকের গলা জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বিজু কী বলছে! ডেকও বেশ উত্তর দিচ্ছে সে-কথার; লেজ নেড়ে নেড়ে, কান নেড়ে নেড়ে, মাঝেমাঝে সামনের পা-দু’টো উপরে তুলে। মায়ের ডাক শুনে ফিরে তাকাল বিজু। হাসি হাসি মুখে বলল—“যাচ্ছি, মা!” সকালের রাগ-অভিমান আর মন-খারাপের আর ছিটেফোঁটাও নেই তার মনে।
মা জিজ্ঞাসা করলেন—
“কী কথা হচ্ছিল রে কুকুরের সঙ্গে!”
ঘাড় নেড়ে বিজু বলল—“ও কিছু না!”
আসলে আজকের এই দিনটার জন্য বিজু ডেককে “থ্যাঙ্কস” দিচ্ছিল, আর ডেক বলছিল, “ধুর! বন্ধুকে কেউ থ্যাঙ্কস বলে!”
কিন্তু মা-কে আর সেসব কথা বলে কী হবে! বড়োদেরকে সব কথা না বলাই ভালো!

-সাকিলা খাতুন 


Popular Books


Comments

  • সুজয় সাহা

    ভালো

    Mar 20 2024

Write a Comment