Image-Description
Stories
ফেলু
Sep 5 2023 Posted by : সঞ্জীবকুমার দে

‘এরে আপনি চুরি বলতেছেন?’ একরকম যেন রুখেই উঠল ফেলু। 
‘চুরি নয়তো কী হতভাগা!’ ধমকে উঠলেন ছোটকা, ‘দশটাকা থেকে ক’পয়সা ফেরত দিলি আমাকে? আর সিগারেটের দাম কত নিয়েছে?’
‘সিগারেট এক প্যাক সাড়ে আট টাকা। সেটা নেছে মোড়ের দোকানদার। আর সিগারেট আনার দক্ষিণে বাবদ একটাকা, নেছি আমি।’ ফেলুর সহজ ও সাবলীল স্বীকারোক্তি।
‘সিগারেট আনার দক্ষিণে — মানে!’ অত ডাকাবুকো মানুষ ছোটকা পর্যন্ত ঘাবড়ে গেলেন ভীষণরকম।
‘এজ্ঞে এটাই আমার নেয়ম। যেমন যেমন জিনিস আনতে দিবেন তেমন তেমন বুঝি আমারে দিতি হয় দক্ষিণা। না দিলিও আমি নিজেই তা কাটি রাখি। এ বাড়ির সক্কলে তা জানে।’
সত্যিই তাই। এ বাড়ির সকলেই আমরা ফেলুর এই গুণপনার সঙ্গে পরিচিত। শুধু পরিচিত নন ছোটকা। তাঁকে আমরা কেউ ফেলুর এই কীর্তির কথা জানতে পর্যন্ত দিইনি। এর কারণ দু’টি। এক, ছোটকা খুব বদরাগী, পাছে ফেলুকে কিছু করে বসেন — এই ভয়ে। আর দুই, এ বাড়ির কাজে ফেলুকে হাতে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনি, যদি দুঃখ পান, তাই।
আজ মাস তিনেক হল আমাদের বাড়ির কাজে লেগেছে ফেলু। বহু চেষ্টা-চরিত্তির পরে, এদিক ওদিক কাজের লোকের খোঁজে গলদঘর্ম হয়ে শেষমেষ ছোটকা একদিন অফিস-ফেরতা এক সন্ধ্যাবেলা এনে হাজির করলেন ফেলুকে। ছোটকার অফিসের কোনো এক সাব-স্টাফ নিশিদা নাকি এনে দিয়েছেন তাঁর গাঁ থেকে। সর্বক্ষণের জন্য থাকবে ফেলু। যাবতীয় কাজকর্ম করবে, ফাই-ফরমায়েশও খাটবে। যেমন চেয়েছিলাম আমরা। পরিবর্তে খাওয়া-পরা আর মাসান্তে দেড়শ টাকা নগদ। এই নগদ টাকাটা নাকি পাঠাতে হবে সেই নিশিদা মারফৎ ফেলুর বাবার হাতে।
বাবা অবশ্য একটু খুঁত খুঁত করছিলেন —‘এতগুলো টাকা নগদ!’
মেজকা ফিসফিস করে বলেছিলেন বাবাকে —‘তা হোক দাদা। দেখলে তো চেষ্টা করে, কাজের লোক পেতে কত হ্যাপা! তাছাড়া আমাদের যখন খুবই প্রয়োজন—’ 
বলেছিলেন মা-ও, ‘হ্যাঁ, আর আপত্তি কোরো না। কমবয়সী ছেলে, দৌড়ঝাঁপ-ও করতে পারবে খুব! এ-ই পারবে এতগুলো লোককে ঠিক সামাল দিতে।’ 
এরপর আর কোন আপত্তি ওঠেনি। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ফেলু বহাল আমাদের বাড়িতে।
সত্যিই খুব চটপটে ও পরিশ্রমী ফেলু, এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। এই বাবার জুতো পালিশ, ওই ছোটকাকার বন্ধুর বাড়িতে খবর দেওয়া, পরক্ষণেই ঠাকুমার পান এনে দেওয়া, মায়ের ঠাকুরঘরের জন্য গঙ্গাজল আনতে দৌড়ানো! তারপরই হয়তো মেজকা’র কাপড়জামা লন্ড্রিতে দিতে যাওয়া!  মেশিনের মত কাজ, একটুও ভুল হওয়ার ব্যাপার নেই। মুখ ব্যাজারও নেই। কিন্তু বদভ্যাস ওই একটাই — পয়সা হাতে পড়লে তাতে ভাগ বসানো, যা আজ মাস আড়াই ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি আমরা!
প্রথম দু’দিন লেগেছিল ফেলুকে তালিম দিতে। দোকান বাজার চেনাতে। সে ভার নিয়েছিলেন নিজেই ছোটকা। 
তারপরই শুরু ফেলুর কারিগরি।
ঠাকমা-র পান আনতে দেওয়া হয়েছিল একটা পাঁচ টাকার নোট দিয়ে। ফিরে এল একগোছ পান নিয়ে! ফেরত দিল একটি টাকা — ‘এই যে বড়মা, একগোছ পান সাড়ে তিনটাকা। আমার আটআনা। বাকিটা ফেরত।’
‘আমার’ কথাটিতেই কেমন যেন সন্দেহ হল আমাদের। কিন্তু তখন তেমন কোন গুরুত্ব দিলাম না। কিন্তু সেটাই শুরু। এখনও সমানে চলেছে ফেলুর তাণ্ডব!
বাজার, দোকান, রেশন কিছুতেই বাদ নেই। পয়সা তার চাই-ই চাই। আর প্রতিবারই বেপরোয়া স্বীকারোক্তি —‘এই ন্যান বাজার। দু’কেজি আলু, পাঁচশো প্যাঁজ, পটল পাঁচশো, কাটা পোনা চারশো...’ বলেই হিসাব দিতে বসল ফেলু। মুখে মুখে, একেবারে পাই টু পাই হিসাব। কোন খুঁত নেই। খুঁত শুধু শেষে এসে, ওই একটাই — ‘...আর আমার একটাকা —’
এভাবে অন্তত দৈনিক দেড় থেকে দু’টাকা পর্যন্ত কব্জা করে ফেলু। কোন কিছুতেই তার ছাড় নেই, বাছ-বিচার নেই। বাবার জুতো পালিশের পয়সা থেকে শুরু করে ছোটকাকিমার সূচ আনতে দেওয়ার পয়সায় পর্যন্ত তার কমিশন।
অথচ কিচ্ছুটি বলার উপায় নেই। শুধু তোয়াজে তোয়াজে রাখা। ভয়, এই বুঝি জবাব দিয়ে চলে গেল সে! ভয় দু’টি কারণে। প্রথমত, কাজের লোক মেলা কি দুষ্কর —তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি আমরা। দ্বিতীয়ত, ফেলু চলে যাওয়া মানে সমস্ত বাড়িটা পঙ্গু হয়ে যাওয়া।
এতসব কাণ্ডের পরেও ছোটকা-কে আমরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিইনি ফেলুর তাণ্ডব। কিন্তু যা বোঝাবার আজ নিজেই বুঝিয়ে দিল ফেলু ছোটকাকেও রেহাই না দিয়ে ! ছোটকার হাতে সিগারেটের প্যাকেট আর একটা আধুলি ধরিয়ে তাঁর বিস্ফারিত চোখের সামনে দিয়ে গটগট করে জলের বালতি হাতে বেরিয়ে পড়ল ফেলু।
সেদিনই আমাদের সকলকে নিয়ে মেজকার ঘরে জরুরি সভা ডাকলেন ছোটকা। বাবা বললেন, ‘ওর এই বেয়াদপি বন্ধ করানো দরকার।’
মেজকা বললেন, ‘ওকে চটিয়ে দরকার নেই। যেভাবে চলছে চলুক। আমরা বরং ভেতরে ভেতরে আর একটা লোকের খোঁজ করি।’
মা বললেন, ‘আর একটা লোক পেতে পেতে তো আমাদের সর্বস্বান্ত করে দেবে !’
‘তা বটে।’ মেজকা বললেন, ‘তবে ওর লোভটাকে বাড়তে না দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’
ঠিক হল, ফেলুর হাতে হিসাব করে টায়টায় পয়সা দেওয়া হবে। যাতে ওর হাতে একদম বাড়তি পয়সা না থাকে। তাতেই বাছাধন জব্দ হয়ে যাবে।
কিন্তু এখানেও আমরা উলটে ফেলুর কাছে জব্দ হয়ে গেলাম। দু’কিলো আটা আনতে দেওয়া হল ফেলুকে সাত টাকা কুড়ি পয়সা হাতে দিয়ে। একেবারে গোনাগুনতি পয়সা। ফিরে এসে ফেলু আটার ঠোঙা তুলে দিল মায়ের হাতে। গম্ভীরভাবে বলল —‘এক কিলো আটশো আছে। দু-কিলো আনলে আমার কিছু থাকতো নি।’
এরপর ঠিক হল, ফেলু শুধু আমাদের প্রয়োজনমত দোকানে গিয়ে জিনিসপত্র নিয়ে আসবে। দাম শোধ দিয়ে আসবেন বড়রা। আর বাজারে ফেলুর সঙ্গে যাব আমি। পয়সাকড়ির লেনদেন হবে আমার মারফৎ।
এভাবেই চলতে থাকল দিন। ফেলু নির্বিকার। কথায় কথায় আমাকে বলে বসল একদিন —‘আপনারা ভাবিছেন ফেলুরে খুব জব্দ করিছেন, না—? কিন্তু ক্ষেতি আপনাদের ঠিকই হয়ি যেতিছে। দোকানি-বাজারিরা আমার ভাগের পয়সা ঠিক ঠিকই কাটি রাখতিছে!’ 
‘মানে!’ বিস্ময় প্রকাশ করলাম আমি।
‘ও আপনে বুঝবেন নি ! আমার সব বলা-কওয়া আছে।’
ব্যাপারটা বাড়িতে বলতেই গর্জে উঠলেন ছোটকা —‘দূর করে দেব ব্যাটাকে! চোর কোথাকার!’
‘পারবেন নি।’ শান্তভাবে বলল ফেলু, ‘আমি নিজে থিকে না গেলে আপনারা আমারে খেদাতে পারবেন নি।’
‘মানে!’
‘হাটে-বাজারের দোকানিরা, মায় পাড়ার পেত্যেকটা লোক আমারে চেনে, ভালবাসে। আমারে তেমন কিছু করলে তারাই আসি পাশে দাঁড়াবে।’
‘বেরিয়ে যা হতভাগা! যা এক্ষুণি!’ গর্জে উঠলেন ছোটকা, ‘এতবড় সাহস ! খুন করব তোকে !’
উত্তেজিত ছোটকা তেড়ে যাচ্ছিলেন ফেলুর দিকে। বাবা আর মেজকা মিলে কোনক্রমে তাঁকে সামলালেন।
ফেলু সহজভাবেই সামনে দিয়ে হেঁটে তাঁর ঘরে চলে গেল।
মিনিট তিনেক পরেই আবার আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল সে। হাটে একটা বেবিফুডের বড় কৌটো। ধপাস্ করে সেটা ছোটকার সামনে বসিয়ে দিয়ে বলল— ‘এই ন্যান আপনাদের সমস্ত পয়সা। একটাও খরচ করিনি। চুরিও করিনি। শুধু আপনাদিগে একটু আক্কেল দিতি চেয়িছিলাম।’ হঠাৎ যেন গলা ধরে এল ফেলুর, ‘গাঁয়ে দুবেলা দুমুঠো শাক-ভাত খেতি পেতাম। একটু-আধটু পড়াশুনার সুযোগ ছিল, পড়াশুনা করতাম। আবার বাবার সঙ্গে ক্ষেতের কাজও করতাম। আপনাদের জন্যিই তা হল নি—’
বলতে বলতে ফুঁসে উঠল ফেলু —‘আপনারাই আমার মত গরীব ছেলেমেয়েদের বাপ-মায়েদের টাকার লোভ দেখায়ে বাধ্য করেন আমাদিগে নেব্বাসনে পাঠাতে। আপনাদিগের জন্যিই বাড়ি-ঘর ত্যাগ করি, বাপ-মা ভাইবোনদিগে ফেলি আমাদের আসতি হয় বাবুর বাড়ির কাজে! তাই আপনাদিগে শিক্ষে দিবার জন্যিই এসব করিছি।’
আমরা হতবাক।
‘এই আমি চললাম।’ হাতের চেটোয় চোখ মুছল ফেলু 
—'আর এখেনে থাকব নি। দয়া করি নিশিকাকারে শুধু বলি দিবেন — আপনারা আমারে তাড়ায়েছেন, আমি কাজ ছাড়িনি।’
আমাদের নির্বাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে ফেলু রাস্তায় বেরিয়ে গেল।

 

লেখক : সঞ্জীবকুমার দে


Popular Books


Comments

  • xZlUsknWhyr

    gGJnUOeakbDBcLlr

    Mar 14 2024
  • xZlUsknWhyr

    gGJnUOeakbDBcLlr

    Mar 14 2024
  • xZlUsknWhyr

    gGJnUOeakbDBcLlr

    Mar 14 2024

Write a Comment