Image-Description
Stories
পাঙাশ ভূতের গপ্প
Jul 12 2023 Posted by : montajpublishing

মাসটা যখন জুলাই তখন আকাশ তো মেঘে ঢাকা থাকবেই, আর বৃষ্টিও পড়বে বেশ জোরে। তবে শ্রাবণ মাসের মত অঝোর ধারায় না হলেও যখন পড়বে তখন পড়বে একেবারে ঝমঝম করে। কড়কড় করে বাজও পড়বে। মোটামুটি দিনের বেলা বেশি না হলেও বিকেলের দিকে বা রাতের দিকে।

রাস্তাঘাটে আজকাল জল জমে না, এমন রাস্তা কই? তাই কিংশুকের এক মহা মুশকিল। বিকেলের খেলাটা মাটি। মা তো কিছুতেই বাইরে বেরোতে দেবে না। জলে কাদায় পড়ে মাখামাখি হয়ে ছেলেটা অসুখে বিসুখে পড়ুক আর কী!

সেদিন তো সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যটাকে মুখ বাড়াতে দেখলেই মেঘগুলো যেন হৈ হৈ করে ছুটে এসে ঢেকে দিচ্ছে তাকে। আর বৃষ্টি তো নয় যেন ছাঁকনি দিয়ে গলে পড়ছে তো পড়ছেই।

মা তেড়ে বকুনি দিয়েছে, 'আজ যদি খেলতে গিয়ে ভিজে আসিস তুই তো তোর একদিন কি আমার একদিন!'

অতএব কিংশুকের ‘একদিন’টাই থাক। মায়ের একদিন ডেকে এনে হাত পা ভাঙ্গুক বা পিঠের ছাল-চামড়া উঠুক তা সে চায় না একেবারেই। ঝম ঝম করে বিষ্টি পড়ছে।

বারান্দায় এল কিংশুক। বারান্দাটা বেশ চওড়া। এখানে ইজি চেয়ারে বসে বই পড়ছে দাদু।

কিংশুক আর কী করে, গুটি গুটি দাদুর পাশে এসে দাঁড়ায়। দাদু চোখ তুললেন, মনে হচ্ছে খুব একটা সমস্যায় পড়েছ দাদুভাই?

কিংশুকের কান্নামাখা মুখ দেখেই বুঝেছেন দাদু। বললেন, 'বুঝেছি মা খেলতে যেতে দেয় নি, এই তো?'

মুখ গোঁজ করে চুপ করে রইল কিংশুক। দাদু বললেন, 'মায়ের কথা শুনতে হয়। সে যাক। এই বর্ষায় কোন জিনিসটা সবচেয়ে ভাল দাদুভাই?'

মুখে হাসি ফুটল কিংশুকের। প্রথমেই মনে এল গরম খিচুড়ি আর ডিমভাজার কথা। তারপরে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজার কথা। তারপর এক এক করে গরম পাঁপড় ভাজা, জিলিপী থেকে শুরু করে বিস্তর জিনিস মাথায় এসে ভিড় করল। কিন্তু কোনটা যে বলবে সেটা ঠিক না করতে পেরে চুপ করে রইল কিংশুক।

- তবে আমি বলি?

কিংশুক উত্তর দিল না। দাদু গলা একটু নামিয়ে বলল, 'আমার মনে হয় এই ঝমঝমে বিষ্টিতে সবচেয়ে ভাল হল ভূতের গপ্প।'

তখন আকাশে কালো মেঘে আরও বেশি করে জমতে শুরু করেছে। চারিপাশটা বেশ অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ভূতের কথায় বুকের ভেতরটা ধুক পুক করে ওঠে না কার? কিন্তু ভূতের গল্প যদি ইজি চেয়ারে বসা দাদুর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে শোনা যায় তো ভয় নিজেই তো ভয়ে পালায়। আর রেখে যায় যা তা হল দারুন মজা।

দাদুর কোল ঘেঁষে চলে এল কিংশুক। দাদু সস্নেহে তাকে দু হাতের বেষ্টনীতে টেনে নিয়ে বললেন, 'বল দাদুভাই বল। যা বলছি বল।'

সুর করে বলতে থাকেন, 
'ভূত আমার পুত, 
পেত্নি আমার ঝি,
আমি দাদুর বুকের ভেতর, ভূতে করবে কী?'

কিংশুক তাই বলল। তারপর খুব খুশি হয়ে বলল, এবার আর ভূতে কিছু করতে পারবে না দাদু। তুমি বল।

- এ গল্পটা আমার বাবা বলেছিল আমায়। দাদু শুরু করলেন, 'মানে তোমার বাবার দাদু। মানে তোমার প্রপিতামহ।'

কিংশুক একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ গল্পটা বল না!

- আজকের এই দিনটার মত সেদিনও আকাশে এমন অন্ধকার করা মেঘ। কখনও ঝম ঝম আবার কখনও ঝির ঝির ― জল তো পড়েই যাচ্ছে। আমার বাবার ছিল খুব মাছ ধরার নেশা। এমন বিষ্টির দিনে নেশাটা তার খুব জমে উঠত। ছিপ, সুতো, বঁড়শি আর চার দিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটা দিত খয়রা পিসির ঝিলে।

-খয়রা পিসির ঝিল আবার কী গো দাদু?

-সে বাবার সময়ে এক বুড়ি পিসি মানে পাড়াতুতো আর কী - ছিল। সে মারা যেতে এই ঝিলের ধারে তার সৎকার করা হয়েছিল। মানে পোড়ানো হয়েছিল আর কী! বুড়ি নাকি পরে ভূত হয়ে যায় আর ঝিলটার নাম সবাই দেয় খয়রা পিসির ঝিল।

-তারপর?

ভূতের ভয়ে সেদিকে কেউ আসত না সচরাচর। বিশেষ এমন বাদলার দিনে। কিন্তু বাবার তো মাছ ধরার নেশা। নেশা ভয়কে তাড়িয়ে দেয় অনেক সময়।

এবার কিংশুক আর কিছু বলল না।

-তারপর এদিকে বাবা ছিপ নিয়ে বসে আছে তো আছেই। মাছের নেই পাত্তা। বাবা মাছের চার বানাতো ফাস ক্লাস। অনেক মাছ তো শুধু চারটা ঠুকরে ঠুকরে খেয়েই পালাতো। বঁড়শির ধারে কাছে মুখ ঠেকাতো না। ঘন্টা তিন চার বসে থেকে অন্তত একটা পুঁটি মাছ গেঁথেও দারুন আনন্দ হত বাবার। লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফিরত।

খুব মজা পাচ্ছে কিংশুক তা বোঝা যাচ্ছে। দাদু আবার শুরু করলেন, তা সেদিন প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে। সেই গাঢ় অন্ধকারে বাবাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। একে তো কালো মেঘে ঢাকা তাতে সর্বক্ষণ বিষ্টি। তাতে আবার বাবার মাথেয় কালো ছাতা।

যে মাছ ধরে সে ছিপ ধরে টানে। কিন্তু এ এক ভারি অদ্ভুত ব্যাপার। এক সময় সেই ছিপে টান পড়ল জলের ভেতর থেকে। বেশ জোর টান ধরে রাখাই যায় না। কিন্তু বাবার মানে তোর বাবার দাদুর মাথায় তো বুদ্ধি। চট করে ছিপের সুতোটা পাড়ের একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে দিল। অমনি আর যায় কোথা। ফাতনা সমেত যেটা পাড়ে উঠে এল –

কিংশুক জিজ্ঞেস না করে পারল না, 'সেটা কী দাদু?'

তার বুক ঢিবঢিব করছিল। এই ঠান্ডাতেও গায়ে ঘাম এসে যাচ্ছিল।

- সেটা একটা মাছ রে দাদুভাই। একটা মাছ। একটা পেল্লায় বড় পাঙাশ মাছ।

স্বস্তি পেল কিংশুক। যাক তবে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু মজাটাই যে মাটি। চেঁচিয়ে বলল, দূর তাহলে ভূত কই?

দাদু আবার শুরু করল, কিন্তু আমি তো অবাক। মাছ এত বড় হয় নাকি? বিশাল বড় একটা হাঁ করে আবার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমাকে খাবে বলে।

- মানুষ মাছ খায়। মাছ কী করে মানুষ খাবে দাদু?

- আসলে আকার হল আসল কথা। যে বড় সে ছোটোকে খায়। যেমন ধর রুইমাছ পুঁটিমাছকে খায়, রুইমাছকে বোয়াল মাছ খায়। সে যাই হোক। শোন তবে গল্পটা। সেই বিশাল পাঙাশ মাছের মাথায় আবার দুটো শিং। বাবা খুব সাহসী হলেও অমন পেল্লায় মাছ তো জীবনে কখনও দেখে নি। প্রথমটায় বেশ ঘাবড়ে গেল যখন সে বলল, 'আমাকে অসময়ে জাগিয়েছিস এর শাস্তি কী জানিস?'

বাবা তো তো করে বলল, 'ক্কী কী শাস্তি?'

- তোকে আমার পেটে যেতে হবে।

বাবা আর কী করে। কিন্তু এই রহস্যটা তো উদ্ধার করতেই হবে। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু আপনি কে প্রভু? আর আমাকে শাস্তি দেবেন কী অপরাধে?

- আমি পাঙাশ ভূত। বলে হা হা হা করে হেসে নিল মাছটা। সেই হাসিতে বৃষ্টির যে জলগুলো পড়ছিল তার মুখে সেগুলো সব বিরাট বড় বুড়বুড়ির ফেনা হয়ে ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল চারদিকে। কোথায় যেন কড় কড় করে একটা বাজ পড়ল। ঝক ঝক করে বিজলির আলোয় সেই বুড়বুড়িগুলো হিরের টুকরোর মত ঝক ঝক করতে লাগল। সে কী দৃশ্য দাদুভাই!

হাসি থামিয়ে পাঙাশ ভূত বলল, আমাকে তুই অসময়ে জাগিয়েছিস কেন বল?

বাবার কাছে শোনা গল্প। বাবা আমাকে বলল, জানিস দীনু এই কথা শুনে আমার তো বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। তবু সাহস রেখে বললুম, প্রভু পাঙাশ ভূত, এটা তো বর্ষার সন্ধে। ঝম ঝম বৃষ্টির মধ্যে ছপ ছপ করে হেঁটে এসে, ঝিলের ধারে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরার তো এটাই সময় প্রভু। বলুন আমি কী অন্যায় করলুম?

কিন্তু ভূতকে বোঝায় কে? সে বলল, 'জানিস এই ঝিল কার নামে?'

- জানি খয়রা পিসির নামে। খয়রা পিসি মারা গেল। ঝিলের ধারে পোড়ানো হল।

- না একেবারেই না। 
গর্জন করে উঠল পাঙাশ ভূত, তুই ভুল জানিস। সে চিতা যে নিভে গেল বিষ্টির দাপটে। ঝোড়ো হাওয়ায় গড়িয়ে গিয়ে পিসি পড়ল এই ঝিলের জলে।

দাদুভাই, আমার বাবা তো থ। সেই ভাবেই জিজ্ঞেস করল, তা লোকে যে বলে ―

- ভুল বলে। চিতায় পুড়লে আবার ভূত হয় কেউ?

বাবা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেছিল, 'তবে?'

- বুড়ি তো জলে পড়ল। আমি এই পুকুরের সবচেয়ে বড় পাঙাশ মাছ তাকে একটু একটু করে ঠুকরে ঠুকরে খেতে লাগলুম। কিন্তু বুড়ি তো তখনও বেঁচে ছিল।

আমার বাবা তখন প্রায় ভিরমি খায় আর কী! বলল, বেঁচে ছিল মানে?

- বেঁচে ছিল মানে বেঁচে ছিল। বুড়ির বাড়ির লোকজন বুড়িকে দিয়ে জোর করে সম্পত্তি লিখিয়ে ঝিলের ধারে এনেছিল মড়া বলে চিতায় পোড়াবে বলে। ব্যাস সব রাগ গিয়ে পড়ল আমার ওপর! খয়রা পিসি রাগে গরগর করতে করতে বলল, আমি বেঁচে ছিলুম কিন্তু কুরে কুরে খেয়ে তুই আমাকে মেরে দিলি। এখন আমি ভূত হলুম আর তুই আমার অভিশাপ ভোগ কর। ব্যাস, আর কী! বুড়ির অভিশাপে আমার আকার বড় হতে লাগল। এই বিরাটা আকার। আমি তলিয়ে গেলুম ঝিলের একেবারে তলায়। তলিয়ে যেতে যেতে মিনতি করে বলতে লাগলুম, খয়রা পিসি গো ও খয়রা পিসি। পুরো ভূত হওয়ার আগে আমাকে প্লিজ বলে যাও এত বড় দেহটা নিয়ে আমি খাব কী? ঝিলের সব প্রাণীদের খেয়েও যে আমার খিদে মিটবে না।

-পিসি কী বলল? 
চোখ বড় বড় করে প্রশ্নটা করে বসল কিংশুক।

দাদু বলল, 'শোন তবে বাকি গল্পটা। আমার বাবাকে পাঙাশ ভূত যে গল্পটা বলছিল। পাঙাশ ভূত বলল, পিসি তখন আমাকে বলল তবে তুই ঘুমিয়ে থাক। তাতে তোর আর খাবার লাগবে না।'

কিন্তু পাঙাশ ভূত বড় বেয়াড়া। বলল, 'কিন্তু কেউ যদি ছিপ ফেলে আমাকে ধরার চেষ্টা করে তবে তো ঘুম ভেঙ্গে যাবে? আর আমার খিদে পাবে। তখন?'

পিসি বলল, 'তা সে যদি হয় তো হতেই পারে। কিন্তু সেটা হবে যদি কেউ বিষ্টির দিনে ভর সন্ধেবেলা কালো ছাতা মাথায় দিয়ে মাছ ধরে। সে ঘুম ভাঙাতে পারে তোকে অসময়ে। তখন তাকে শাস্তি দিবি।'

- কী শাস্তি গো পিসি?

- সে তোর ইচ্ছে মত হতে পারে। তা, ধর তোর মাথার শিং দিয়ে তার পেট ফুটো করে দিতে পারিস। পেট ফুটো হয়ে মারা গেলে গপাং করে তোর বড় হাঁ দিয়ে গিলে নিবি। তোর খিদে মিটলে আবার তুই ঘুমিয়ে পড়বি।

আবার চোখ বড় বড় করল কিংশুক, তারপর?

- তারপর আর কী? আমার বাবা সঙ্গে সঙ্গে ছিপ টিপ সব ফেলে রেখে দে দৌড়। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি আসতেই মা বলল, 'কী গো মাছ উঠল তোমার ছিপে?'

বাবা হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, তুলতে পারলুম না গো যা বড়।

- কী মাছ? পাঁচসেরি কাতলা না দশ সেরি মৃগেল?

- না পাঙাশ...

- পাঙাশ মাছ এত ভারী?

- পাঙাশ মাছ নয় পাঙাশ ভূত! আর কখনও যাচ্ছি না বাবা বিষ্টির সন্ধ্যায় মাছ ধরতে।

দাদু গল্প বলা শেষ করল। কিংশুক আস্তে আস্তে বলল, 

- দাদু...

- কী দাদুভাই?

- পাঙাশ ভূত কি বিষ্টিতে যারা মাছ ধরে তাদের খায়?

- শুধু তা কেন হবে? যারা বিষ্টিতে জলে কাদায় খেলে তাদেরও ধরতে পারে।

- আমি আর বিষ্টির সন্ধ্যায় খেলতে যাব না কোনোদিন। কথাটা বলেই কিংশুক দাদুকে বেশ জোরে জড়িয়ে ধরল।

সমাপ্ত

অরুণ চট্টোপাধ্যায়


Popular Books


Comments

  • Rumna Gupta

    অসাধারণ লাগলো গল্প তি। শিশু দের জন্য ছোট দের জন্য বেশ সুন্দর একটা গল্প।

    Jul 12 2023
  • PARAMES GHOSH

    Five Star ***** ভালো লাগলো পাঙাশ ভূতের গপ্প, খালি একটা কথা মনের মতো ্ - ‘যারা বিষ্টিতে জলে কাদায় খেলে তাদেরও ধরতে পারে’। 

    Jul 14 2023
  • PARAMES GHOSH

    Five Star ***** ভালো লাগলো পাঙাশ ভূতের গপ্প, খালি একটা কথা মনের মতো নয় - ‘যারা বিষ্টিতে জলে কাদায় খেলে তাদেরও ধরতে পারে’।

    Jul 14 2023

Write a Comment