জীবনেও কোনোদিন ভাবিনি যে কখনও জ্যান্ত সরস্বতী পুজো দেখব। হ্যাঁ, সত্যি বলছি কোনোদিনই ভাবিনি ও দেখিনি। কিন্তু আজ স্বচক্ষে সেটারই ঘটা করে দর্শন লাভ করলাম। এইবারে না হয় আসল ঘটনাটা খুলে বলি, পদ্ম পুকুরে যে টুনি ক্লাবটা রয়েছে না ওই টুনি ক্লাবেই প্রতি বছর ঘটা করে সরস্বতী পুজো করা হয়। আর করা হবে নাই বা কেন? পদ্মপুকুরে তো সেইভাবে স্কুল-কলেজ নেই, আর তা ছাড়া সবার বাড়িতে সরস্বতী পুজোও হয় না। তার কারণ পদ্মপুকুর হল একটা ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রামে বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরা তো পড়াশোনাই করে না। এর পেছনেও যথেষ্ট কারণ রয়েছে, এই গ্রামের প্রত্যেক পুরুষের কমবেশি পেশা হল চাষ। সারাটা দিন মাঠই হল যার জীবন সেইখানে দাঁড়িয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা হবে কীভাবে? সূয্যি মামা আকাশে দেখা দিলেই দিনমজুরি করতে বেরিয়ে যেতে হয়। সেই ছোট্ট থেকে বাবারা ছেলেদের চাষবাস সম্পর্কে শিক্ষা দেন এবং মাঠে নিয়ে গিয়ে চাষ করানো শেখান। আর যদিও তারা পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক হয়, তবুও ওই বড় জোর প্রাইমারি পর্যন্তই। ওর বেশি আর পড়াশোনা এখানকার পদ্মপুকুরের ছেলেরা করে না। প্রথমত, উচ্চতর প্রাথমিক মানে হাই স্কুল এই গ্রামে নেই। এখান থেকে প্রায় দশ-বারো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলে তবে একখানি সরকারি হাই স্কুল দেখতে পাওয়া যায়। তো যাইহোক এইবারে সরস্বতী পুজো ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা অনুসারে পড়েছে আগামী ১৪ই ফেব্রুয়ারি। টুনি ক্লাব প্রতিবারের মতন তাদের পুজোর প্রস্তুতি অন্যবারের মতন এবারেও জোর কদমে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সমস্যা বাঁধল অন্য এক জায়গাতে। আসলে যিনি এই ক্লাবের সরস্বতী পুজোটা করেন মানে শ্যামাচরণবাবু, তিনি একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলেন যে মা বলছেন এইবারের সরস্বতী পুজো কিন্তু মূর্তিপুজো নয় অন্যভাবে, অন্য পদ্ধতিতে করতে হবে। স্বয়ং মায়ের এই স্বপ্নাদেশ পেয়ে শ্যামাচরণ বাবু এবং ক্লাবের ছেলেদের রীতিমতো মাথায় হাত পড়েছে। তার কারণ অন্যভাবে বলতে কীভাবে করবেন? মূর্তি যদি না হয় তাহলে পুজোটা হবে কীসে? তাহলে মাকে সত্যি সত্যিই মর্ত্যে আনতে হবে? কিন্তু সে তো এই কলিযুগে অসম্ভব। কিন্তু এইদিকে চিন্তায় চিন্তায় বেচারা শ্যামাচরণবাবু মানে পুরোহিত মশাই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। জল গ্রহণ পর্যন্ত করছেন না তিনি। কিন্তু এইদিকে কী হবে? সরস্বতী পুজো তো দোরগোড়ায় উঁকি দিচ্ছে। হাতে মাত্র কয়েকটা দিন। তো যাই হোক গ্রামের এক বিচ্ছু ছেলে ঋজু, ক্লাবে এসেছে। ঋজুকে বিচ্ছু বললাম তার অবশ্য অনেকই কারণ রয়েছে, ঋজু খুবই বদমাশ ছেলে। গ্রামের এর ওর বাড়িতে লুকিয়ে যাবে তারপরে ঢিল মেরে আম পেড়ে খাবে, বেল পেড়ে খাবে। কখনও কখনও এমন হয়েছে ঢিলটা গাছে না লেগে সোজা কারোর বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে। তবে ওই কথায় আছে না 'য পলায়তি স জীবতি' এখানেও তাই দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছে ঋজু। তবে ধরা যে ঋজু পড়েনি তাও নয়। অনেকবারই ধরা পড়েছে এবং লাঠি পেটাও খেয়েছে। তবে তাতেও যে ওর খুব একটা শিক্ষা হয়নি সেটা ওর মুখের অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট। যাই হোক ঋজু এসে ক্লাবের ছেলেদের জিজ্ঞেস করল,"আচ্ছা সৃষ্টদা, শুনলাম এইবছর নাকি নমো নমো নমো করে সরস্বতী পুজো হবে?"
সৃষ্ট এক গাল ভরা দুঃখ নিয়ে বলল,"ওটাও মনে হয় না হবে, স্বয়ং দেবী সরস্বতী পুরোহিত মশাইকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন এইবারে মূর্তি পুজো নয়, অন্য কোনো ভাবে পুজো করতে হবে। মানে মোট কথা স্বয়ং মাকে ডেকে নিয়ে এসে পুজো করতে হবে।"
ঋজু বেশ হেসে বলল,"কিন্তু মা কি আমার তোর মুখ দেখতে আসবে? মাকে তো মূর্তির বাইরে সামনা-সামনি কেউই দেখেনি। দেখ মাকে তুষ্ট করে ডেকে আনতে পারিস কিনা?" বলে
আবারও ফিক ফিক করে হাসতে দেখা গেল ঋজুকে। আর একটা কথা বলে রাখি, ঋজু সৃষ্টকে দাদা বললেও তুই করেই বলে। ঋজুর কথা শুনে সৃষ্ট বলল,"আচ্ছা ঋজু, তুই ফোড়ন না কেটে কোনো আইডিয়া তো দিতে পারিস!"
ঋজু শুনে 'আইডিয়া...আইডিয়া' করে বিড়বিড় করতে লাগল। তারপর হঠাৎই 'আইডিয়া' বলে চেঁচাতে লাগল।
ঋজু বলল,"শোন আমাদের পাড়ার রূপসার মুখটা কিন্তু অনেকটাই সরস্বতীর মতোই দেখতে। ওকে যদি দেবী সরস্বতীর পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কিন্তু দারুণ লাগবে। আর একটা হাঁস কিনে নিবি ওর পা টাকে বেঁধে রাখবি, ব্যাস কাজ মিটে যাবে।"
সৃষ্ট বলল,"তোর মাথাটা কি সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছে? মানে জ্যান্ত সরস্বতী পুজো। এও কী সম্ভব? আর তুই বললি হাঁসের পা বেঁধে রেখে দিতে, ওরে হাঁসের পা বেঁধে দিলে ও চিৎকার করবে না?"
ঋজু বলল,"ঠিক আছে। তুই আমার বাড়িতে সরস্বতী পুজার আগের দিন হাঁসটা পাঠিয়ে দিবি। তারপরে দেখবি খেলা...!"
সৃষ্ট বলল,"ঠিক আছে। তোর কথা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি পুরোহিত মশাইকে বলছি। দেখা যাক তিনি রাজি হন কিনা?"
তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সৃষ্ট পুরোহিত মশাইয়ের বাড়িতে চলে গেল। সেইখানে গিয়ে ঋজুর পুরো প্ল্যানটা পুরোহিত মশাইকে সৃষ্ট খুলে বলল। পুরোহিত মশাই প্রথমে গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপরে পুরোহিত মশাই সৃষ্ট-র প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। যাই হোক, এইবার দেখার পালা মানুষরূপী সরস্বতী পুজোর! পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে। এইদিকে সারা গ্রামের দেওয়ালে দেওয়ালে পোষ্টার পড়েছে জ্যান্ত সরস্বতী পুজোর। 'দেখে যান। প্রবেশ অবাধ।' দেওয়ালে পোষ্টার পরার পর থেকে মানুষের মনে যে একটা কৌতূহল ও উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে সেটা তাঁদের মুখ দেখলেই স্পষ্ট। পদ্মপুকুরের চারিদিকে সরস্বতী পুজো নিয়ে আলোচনা। চায়ের দোকানেও মানুষজনের ভিড়, এইসব নিয়ে জোর আলোচনা।
আজই সেই মহাসন্ধিক্ষণ, মানে সরস্বতী পুজো। সর্ব সাধারণের জন্য সকাল থেকেই পুজোর প্যান্ডেলের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। সামনে যেন স্বয়ং মা-ই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মনেই হচ্ছে না এটা একটা মানুষ! যথেষ্ট জাঁকজমক পূর্ণ পুজো করা হয়েছে এইবার। আমিও পুজো দর্শন করে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। শুধু আমি নই বা এই গ্রাম থেকে মানুষ নয় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জন আসছেন এই পুজো দেখার জন্য। এ যেন এক অনবদ্য প্রাপ্তি টুনি ক্লাবের কাছে। তবে এক দিন যেহেতু পুজো তাই যেন নিমেষেই কেটে গিয়েছে দিনটি। আজকে পুজো শেষ। সবাই এখন ঋজুর নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে। কেউ আর এখন ওকে বিচ্ছু ছেলে বলছে না। আসলে পুরো পরিকল্পনা টাই তো ঋজুর। তাই থ্রি চিয়ার্স ফর ঋজু হিপ হিপ হুররে।
(সমাপ্ত)
-সমাদৃত দাস