Image-Description
Stories
পদ্মনাভের ছেলে
Oct 17 2023 Posted by : montajpublishing

অভ্যাস মত ঘুম ভেঙে যায় অনেক ভোরেই। ভালো করে আলো ফোটারও অনেক আগে। কিন্তু কিছুতেই চোখ খুলতে চায় না বলু।
    মাথার কাছের খোলা জানালা দিয়ে বাতাসে ভেসে আসে শিউলির গন্ধ। নিয়ে আসে চেনা-অচেনা এক ঝাঁক পাখির কিচিরমিচির শব্দ। বলু বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। বালিশে মুখ গুঁজে আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। পারে না।
    মা এসে ডাকাডাকি করে তুলে দেন বলুকে— ‘ওঠ বাবা, ওঠ! ওদিকে তোর কাজের দেরি হয়ে যাবে যে—’
    অগত্যা বিছানা ছেড়ে উঠতেই হয় বলুকে। কাঠকয়লার গুঁড়োয় দাঁত মাজতে মাজতে এসে দাঁড়াতে হয় পুকুর ঘাটে। পুকুরের টলমলানো জলে মাথা উঁচানো সদ্য ফোটা শালুক, এক পাড় ধরে ফুটে থাকা লম্বা মাথার কাশ, এসে ধরা দেয় তার দৃষ্টিতে। উঠোনময় ছড়িয়ে থাকা ঝরা শিউলির স্তূপ, গাছের পাতা বেয়ে টুপটাপ ঝরে পড়া হিমেল শিশির, নীল আকাশে ভাসমান সাদা মেঘের ভেলা নাড়া দেয় তাকে। আর তখনই তার বুকের অব্যক্ত যন্ত্রণাটা আরও তীব্র হয়ে ওঠে, মোচড় দেয়। মুখ ফিরিয়ে নেয় বলু। এবারের শরৎ কিছুতেই বশ করতে পারছে না তাকে।
    আসলে শরৎ মানেই তো পুজো। আর পুজো মানেই তো...
    না, এবারের পুজোর আর কোন মানে নেই বলুর কাছে। কোন আনন্দ নেই। কারণ, তার বাবাই যে নেই এবার! থাকবেও না আর কোন শরতে।
    নইলে কি আর এমন সকালে অন্যান্য বছরের মত ঢাক-কাঁসরের মহড়া না করে ইস্টিশান পাড়ায় ক্যান্টিনের কাজে ছুটতে হয় তাকে? সদ্য পাওয়া কাজ। সকলের আগে গিয়ে উনুন ধরাবার তাড়ায় কাকভোরেই ছুটতে হয় তাকে। 
    আজও চোখেমুখে জল দিয়ে পড়িমরি করে দৌড়ল বলু ইস্টিশানের দিকে।
    মনসাতলার মোড় পেরিয়ে পাকা সড়কে এসে পড়তেই কানে ভেসে এল অবিনাশ কোবরেজের আগমনী গান। একটা পালাগানের দল আছে মানুষটার। রোজ ভোরে গলা সাধতে বসেন। বেশ কয়েকদিন ধরেই এবারও শুরু করে দিয়েছেন আগমনী গান। 
    ঢাক বাঁধতে বাঁধতে এসময় বলতেন বাবা— ‘অবি কোবরেজের গলায় শুনিস— আর, আমার ঢাকে শোন। এও হলো আগমনী। আগমনীর বোল!’
    বাবা বাজাত, আর মুগ্ধ হয়ে শুনতো বলু। সে-ও ঠেকা দিত কাঁসরে। আশ্বিনের ভোরে গমগম করে উঠত চারিদিক।
     একটু পর থেকে একে একে ঢাক কাঁধে আসতে শুরু করতো সকলে। বাবার বায়েন দলের সবাই। পরেশকাকা, মধুকাকা, হারানিধিদা আর নরেন সামুই। আরম্ভ হত পুজোর বাজনার মহড়া। কাঁসর ধরতো বলু। ঢাকে ঢাকে বোল উঠত নেচে। কখনও আবাহনীর, কখনও বোধনের, কখনও অর্চনার, সন্ধ্যারতির, শয়ানের, কত কত বোল উঠত বেজে। নতুন নতুন সুর বাঁধত বাবা, নতুন গদ। কোনটা সপ্তমীর জন্য, কোনটা অষ্টমীর, কোনটা সন্ধিপুজোর, কোনটা বা নবমীর রাতের জন্য। বাজিয়ে শোনাত অন্যদের। তারপর তাদের তালিম দিত। তালিম নিতে নিতে থেমে যেত সকলে— মুগ্ধ হয়ে শুনত বাবার তোলা বোল। অবাক চোখে দেখত বাবার কাঠির কারিগরী। তারিফ করে উঠত সমস্বরে। ধমক দিয়ে উঠত বাবা— ‘আঃ, বাজনার সময় মুখে কথা লয়! কথা কইবে ঢাক, শুধু ঢাক!’
    সাধে কী আর সকলে ওস্তাদ বায়েন বলতো বাবাকে! মিছে কদর করত তাঁর? সত্যিই ঢাকে কথা কইত বাবার! আলো ঝলমল পূজামণ্ডপে পিতিমে দেখতে আসা মানুষজন থমকে যেত বাবার ঢাকের বোলে। ভিড় জমে যেত বাবার চারপাশে। মাটির পিতিমেকে যেন জীবন্ত করে তুলত বাবা কি এক ঘোরে! আরতি করতে করতে পুরুতমশাই কেঁদে ফেলতেন ভাবে! ওস্তাদ ধুনুচি-নাচিয়ে ফকির মল্লিক শুধু বাবার খ্যাতিতেই আসত সেই মণ্ডপে। পূজা-কমিটির বাবুরা মস্ত মস্ত বকশিস করতেন বাবাকে। এসব নিজে দেখেছে বলু বাবার সঙ্গে থেকে থেকে। 
    পাঁচ পুরুষের বায়েন বলুরা। বায়েন-মহলে তার বাবা পদ্মনাভের ছিল খুব নামডাক। বায়েনদের এই  দু’চারখানা গাঁয়ে তাঁর সম্মানই ছিল আলাদা। ফি বছর দুর্গাপুজোয় কলকাতার নামকরা ক্লাবগুলির মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত তার বাবাকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু না, যত প্রলোভনই থাক না কেন, সে যাত্রিক ছাড়া কোথাও বাজাত না। ক্লাবের বাবুরাও জানতেন সে কথা, তাই বলা কওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাঁরা জানতেন পৃথিবী দুর্যোগে উলটে গেলেও পদ্মনাভ দলবল নিয়ে এসে ঠিক উপস্থিত হবে পঞ্চমীর ভোরে! পাঁচ পুরুষ ধরে এই মণ্ডপে বাজাচ্ছে তারা। তাই এ তো পদ্মনাভের নিজেরই পুজো। 
    এ কথা বলত বলুর বাবা নিজেও— ‘শুধু লিতে যাই না গো ঢাক বেঁধে, কিছু দিতেও যাই। আমাদের পাঁচ পুরুষের সাধনার থানে মায়ের নাম ভজতে যাই।’
    মনে পড়ে বলুর— সন্ধ্যেবেলা, যখন পরেশকাকা, হারানিধিদা’রা থাকত না, তখন আর কাঁসর নয়, একটু একটু করে তাকে ঢাকের বোল শেখাত বাবা। তার মত ছোট ছেলের পক্ষে অতবড় ঢাক কাঁধে তোলা সম্ভব ছিল না বলে মাটিতে কাত করে দাঁড় করিয়ে রেখে শেখাবার চেষ্টা করত বাবা। শেখাত দু’কাঠির নানারকম কারিগরী। উৎসাহ দিত বলুকে— ‘এ বছর তোর বয়স বারো, পরের বার তেরো, তারপর চোদ্দ। একদিন ঢাক কাঁধে তুলতেই হবে তোকে। বাজাতে হবে বাপ-ঠাকুর্দার মত।’ তারপরই প্রশ্ন করত— ‘কিরে, পারবি নে?’
    ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাত বলু— সে পারবে।
    আজ এসব কথা মনে পড়লে বুকটা হু হু করে ওঠে বলুর— না, তার যে পেরে ওঠা হল না। 
    শরৎ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভেবেছে বলু— যা হয় হোক, ঢাক এবারই কাঁধে তুলবে সে। শুরু করবে জোর মহড়া। কিন্তু সে উৎসাহ তার দপ্ করে নিভে গেছে, যখন শুনেছে পরেশকাকা কলকাতা গে বাবুদের কাছে খুব তদ্বির করছে এবারের বরাত পাওয়ার জন্য! সুতরাং পরেশকাকার মতো বাবার এক নম্বর সহকারীকে বাদ দিয়ে বাবুরা নিশ্চয় ডাকবে না বছর তেরোর এক আনাড়ি বাজিয়েকে! 
    আরও শুনেছে সে— পরেশকাকার বাড়িতেই নাকি বসছে আজকাল বাদ্যির মহড়া, তাকে না ডেকে! হয়তো বাবুদের পাকা কথা নে এসেছে পরেশকাকা!
এসব কারণেই আর এ বিষয়ে মাথা ঘামায়নি বলু। বাবা মারা গেছে সেই বৈশাখে। তখন থেকেই সংসারের দায়িত্ব পড়েছে তার কাঁধে। সদ্য পাওয়া কাজটির ওপর নিষ্ঠা রেখে সেই দায়িত্বই পালন করে চলেছে বলু।

বেলা তখন প্রায় এগারোটা হবে। এই সময় ক্যান্টিনে দুপুরের পাত পড়তে শুরু করে দেয়। বলুর ব্যস্ততাও বেড়ে যায় প্রায় কয়েকগুণ। তবে আজ রবিবার বলে ভিড়টা যেন অন্যান্য দিনের মত ভারি নয়।
এমন সময়ই খবরটা দিয়ে গেল সামন্ত-মুদির ছেলে গণেশ— ‘তোমাকে এখুনি একবার জেঠিমা যেতে  বলেছে বলুদা। তোমার খোঁজে শহর থেকে দু’জন লোক এয়েছেন—’
অবাক হতে হয় বলুকে। তার খোঁজে শহরের লোক!—
ঘণ্টাখানেকের ছুটি নিয়ে আবার বাড়ির পথে ছুটল বলু। উঠোনে পা দিয়েই হতবাক হয়ে গেল সে— এ যে যাত্রিকের পুজো কমিটির বাবুরা!
দু’জন-ই বলুর চেনা। একজন হালদারমশাই, ক্লাবের সেক্রেটারি। অন্যজন ডাক্তারবাবু, ক্লাবের কী একজন যেন!
দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে তাঁদের বসতে দিয়েছিলেন মা। দু’জনে কথা বলছিলেন মায়ের সঙ্গেই। দূর থেকে বলুকে দেখতে পেয়ে প্রথমে কথা বললেন ডাক্তারবাবুই, গলা চড়িয়ে— ‘দেখ বলু, তোর জন্য আমরা সেই কখন থেকে বসে আছি!’        
লাজুক মুখে দুজনেরই পায়ের ধুলো নেয় বলু।
‘আমরা কেন এসেছি জানিস বলু?’ বলেন হালদারমশাই, ‘তোর বাবার মৃত্যুর খবর জেনে। পরেশ কয়েকদিন আগে গিয়েছিল। তার মুখে শুনলাম খবরটা!’
কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। কথা নেই কারোও মুখে। 
‘তোর মায়ের সঙ্গে তোর বাবার প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছিল এতক্ষণ।’ বলেন হালদারমশাই, ‘ওকে বলার জন্য তো কোনদিন আসতে হয়নি আমাদের!’ বলতে বলতে একশো টাকার বেশ কয়েকটা নোট তিনি গুঁজে দেন বলুর হাতে। 
—এবার এলাম যখন, তখন পুজোর জন্য তোর ঢাক বায়না করে গেলাম।
    বিস্ময়ে হতবাক বলু। সে কী স্বপ্ন দেখছে! 
    ‘এবারে আমাদের পুজোর একশো বছর। পারিস তো দু’চারজন বেশি নিয়ে যাস দলে।’ বলতে বলতে উঠে পড়লেন হালদারমশাই,— ‘অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আমরা যাই রে!’
    চলে যেতে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়ালেন ডাক্তারবাবু। বলুর কাঁধে হাত রেখে বললেন— 'ক্ষুদে হলেও জাত চেনাস! বুঝিয়ে দিস, তুই পরেশ নোস, বলরাম। পদ্মনাভের ছেলে!'
    ফিসফিস করে বলেন হালদারমশাই— ‘বাপের কাছে তালিম পেয়েছিস তুই। দেখব তোর এলেম!’
    ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে বলু দেখতে পায় আলো ঝলমল পূজামণ্ডপ। সন্ধিপুজোর লগ্ন। বাবার মস্ত বড় ঢাকটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে বাজাচ্ছে, বাবার মতো! বাজাতে বাজাতে ছড়িয়ে পড়ছে পুজোর গন্ধ। সে গন্ধে সে খুঁজে পাচ্ছে বাবাকে। কাছে, খুব কাছে। ঠিক এই শরতের মতোই।

সঞ্জীবকুমার দে


Popular Books


Comments

  • BVsEmgOMUpIlPhd

    brLCZSzjBUonu

    Jan 29 2024
  • BVsEmgOMUpIlPhd

    brLCZSzjBUonu

    Jan 29 2024
  • BVsEmgOMUpIlPhd

    brLCZSzjBUonu

    Jan 29 2024

Write a Comment