বেজায় গরম। ভরদুপুরে গরম লু বইছে, শুনশান রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। গেরস্তবাড়িতে দরজা জানলা এঁটে বিশ্রামরত মানুষজন। চোর,ছ্যাঁচোর, ছিনতাইবাজদেরও আজ অফ ডে। এই রোদ্দুরে, বাইরে ঘোরাফেরা করা অসম্ভব।
ভাগ্যের পরিহাসে, এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মাধবপুর থানার দোর্দণ্ডপ্রতাপ বড়োবাবু ,যাঁর ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়, তাঁকেও এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রাণপ্রিয়, গোলাপিরঙা আহ্লাদি ছাগল চুরির তদন্তের কাজে ব্যক্তিগত হাজিরা দিতে যেতে বাধ্য হতে হয়েছিল। সোনাদানা হলেও না হয় কথা ছিল, শেষমেশ ছাগল!! রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল, মাথার অবশিষ্ট চুলগুলি খাড়া, নাক দিয়ে গরম বাষ্পের মতো ধোঁয়া বের হচ্ছে। নাকের গরম ধোঁয়া, আবার গোঁফের জন্য ক্ষতিকর। একে কেশবিরল মাথা, সেই অভাব পূর্ণ করতে নাকের নীচের পুরুষ্টু গোঁফ জোড়াকে বেশ তোয়াজ করে রাখতে হয়। ফলে ওইটি, তাঁর খুবই স্পর্শকাতর এলাকা। সেটি বিগড়ালে জীবনে আর থাকে কী? তাই মনকে শান্ত করতে চোখ বন্ধ করে একশো থেকে উল্টো গুনতি শুরু করেছিলেন,কিন্তু ওই গোলাপী ছাগল, থেকে থেকেই মনের মধ্যে এসে ঢুঁ মেরে যাচ্ছে। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল "হতচ্ছাড়া"। স্টিয়ারিং হুইলে বসা ড্রাইভার ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলল
"কে স্যার? আমি?"
"আরে না, না। তুমি কেন হবে? আমার ভাগ্য!"
"অ", বলে ড্রাইভার আবার গাড়িতে স্টার্ট দিল। আজকাল আবার কাউকে চটানো চলে না। আগেকার দিন হলে অপরাধী পিটিয়ে, মনের জ্বালা জুড়োনো যেত, এখন আবার কী সব কমিশন, হয়েছে, রে রে করে তেড়ে আসবে। অতএব তিনি মনের রাগ মনেই চেপে বসে রইলেন, কেবল কান দিয়ে হু-হু করে ধোঁয়া বের হচ্ছিল।
থানায় ফিরে, কাজে বসার আগে, কোয়ার্টারে লাঞ্চ সারতে গিয়ে দেখেন, রান্নার মেয়েটির জ্বর, কাঁথা গায়ে কোঁকাচ্ছে। তাঁর গিন্নিটি আবার প্রসাধন ছাড়া, আর বিশেষ কিছুই পারেন না। গ্যাস জ্বালাতে হলেও এমন চিৎকার করেন যেন আরশোলা গায়ে এসে বসেছে। অগত্যা চিঁড়ে দই কলা দিয়ে, কোনও মতে ফুটন্ত মেজাজ সামলে থানায় ফিরে এসেছেন।
গরমের দুপুরে মানুষজন হা-ক্লান্ত, থানায় নালিশ জানাতে আসারও লোক নেই। অতএব নিজের ঘরে এসেই দরজার মাথায় লাল আলোটা জ্বেলে, কপাট ভেজিয়ে চেয়ারে এসে বসলেন।
ঘরের কোণে গরাদের ভিতরে, কাল রাতে ধরা পড়া ছিঁচকে চোরটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। দিন দুয়েক কোর্ট ছুটি থাকায় ব্যাটাকে আপাতত এখানেই রাখতে হবে। সারাক্ষণ একটা ছিঁচকে চোর, চোখের সামনে! ওঃ অসহ্য। তাও মন্দের ভালো বেশি ঘ্যানঘ্যান করে না লোকটা।
এইরকম শুনশান অবসর বিশেষ একটা মেলে না। বড়োবাবু চারপাশে আর একবার সতর্ক নজর বুলিয়ে নিলেন, তারপর ড্রয়ার থেকে সন্তর্পণে হাত আয়নাটা বের করে খুব নজর করে গোঁফটা দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে, বুক থেকে একটা বড়ো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তাঁর এত সাধের জবরদস্ত গোঁফজোড়ায় টাক পড়তে শুরু করেছে।
মাথার টাকে, টুপি অথবা পরচুলা দিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যায়, কিন্তু গোঁফের টাক! পকেট থেকে সরু চিরুনি বের করে আলতো হাতে আঁচড়াচ্ছিলেন, চিরুনিতে আজও একগুচ্ছ গোঁফের চুল ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছে! দেখে চোখে জল আসি আসি করছিল,আচমকা 'খুক্' করে একটা শব্দ।
"এ্যাই কে রে?" গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি। নজরে পড়ল ছিঁচকে চোরটা হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে আছে!
বারান্দা থেকে সিপাইরা মুন্ডু বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে। হাতের ইশারায় তাদের বিদায় করে, চোরের দিকে চেয়ে বললেন,
"হাসলি যে বড়ো! এটা কী নাট্যশালা,নাকি আমার গোঁফ তোর হাসির বস্তু!"
চোরটা উঠে বসে জিভ কেটে, কান ধরে বলল,
"ছি ছি, কত্তা, কী যে কন...আপনার গোঁপটা আমাগো কতো গব্বের বস্তু! আপনার যেমন চেহারা, তেমনি গোঁফ। আমার মাসতুতো ভাইদের, থানার বড়োবাবু আপনার সামনে দাঁড়াইতেই পারে না। এই জন্যিই আপনাকে আমরা কতো ভক্তিছেরেদ্দা করি।"
গোঁফের প্রশংসায়, কিঞ্চিৎ নরম হলেন বড়োবাবু।
"সত্যি বলছিস, না... "
" না না, একেবারে সত্য কথা..তবে অভয় দেন তো একখান কথা কই? "
"বল্।"
"আপনার গোঁপখান ইদানীং এট্টু রোগা হইয়া গেছে। "
হলেই বা চোর, সহমর্মী তো! একটু যেন নরম হল দারোগাবাবুর মেজাজখানা।
"যা বলেছিস।"
"তবে কিনা অপরাধ না নেন তো বলি,যা যাইতে চায়,তারে ছাইড়্যা দেওনই ভালো।"
চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে গর্জন করে উঠলেন। একেই সকাল থেকে একের পর এক হুজ্জুতি, তায় সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছে লক্ষ্মীছাড়াটা। গরম তেলে ফোড়ন দেবার মতো চিড়বিড়িয়ে উঠলেন।
"বড্ডো সাহস না-রে!"
ডান্ডা হাতে সশব্দে চেয়ার ঠেলে উঠতে যাবেন, চোরটা তক্ষুনি ঠোঁটে আঙুল রেখে বললে―
"চুপ যান ছ্যার, ঘরের কথা পাঁচকান কইরা লাভ কী, বরং অনুমতি দিলে একখান সৎ পরামর্শ দিই।"
"পরামর্শ!?"
"হ্যাঁ, বলি কী, পরচুলার মতো একখান পরগুম্ফ লাগাইয়া লন, ঝামেলা খতম। মানে ওই থ্যাটারের মতো আর কী!"
অন্যসময় হলে কী হত বলা যায় না, কিন্তু গোঁফের ব্যাপারে নো রিস্ক।
গলার স্বরটা, কিঞ্চিৎ খাদে নামিয়ে বলেই ফেললেন,
"সে আমি পাব কোথায়?"
"ওই যে কেলাবের ঘরে টিনের বাক্সো ভর্তি দাড়ি গোঁফ ঠাসা। অনুমতি দিলে, আইজ রাতেই, পছন্দ মতো একডজন আইন্যা দিতে পারি। বেশভূষার সঙ্গে ম্যাচ কইরা লাগাইতে পারবেন!"
"হ্যাঁ তোমাকে ছাড়ি, আর এই সুযোগে তুমি পিটটান দাও। "
"না স্যার আপনার দিব্যি। আপনি বরং সঙ্গে একটা সেপাইরে দ্যান।"
"ওরে কী আমার বুদ্ধি! সেপাই সঙ্গে দিয়ে চুরি করতে পাঠাব!"
"তাইলে মাঝরাতে আপনিই চলেন, আপনার সিপাইগুলান তো সব ঘুমায়। কাউকে কিস্যু বলার দরকার নাই, আপনি দিঘির পাড়ে দাঁড়াইয়া, উল্টা দিকে চাইয়্যা হাওয়া খাইবেন, আর আমি এইখান থিক্যাই সটান চইল্যা যামু..."
"মানে? গরাদের ভিতর থেকে তুই বাইরে যাবি কী করে!"
"ও নিয়া ভাববেন না স্যার, আপনাদের তালা খোলা, উও তো মেরে বাঁয়ে হাত কা খেল!"
"খবর্দ্দার! আবার হিন্দি বলে...!" গর্জে ওঠেন বড়োবাবু।
"তবে থাক্।"
পরামর্শটা মন্দ না, সবে নকল গোঁফ নিয়ে মনে মনে পর্যালোচনা করতে যাবেন, এমন সময়ে, বাইরে থেকে মহিলাকন্ঠে, সুর করে বিলাপধ্বনি, এখন আবার কে! বেজায় রেগে টেবিলে রাখা ঘন্টাটায় চাপ দিতেই একজন সিপাই মুন্ডু বাড়ালে। জানা গেল, চোরের বৌ, বাড়ি থেকে, চোরের জন্য চুনো মাছের চচ্চড়ি, বানিয়ে নিয়ে এসেছে। গেটে আটকে দেওয়া হয়েছে, তাই উচ্চৈঃস্বরে কান্না।
চোর বললে, "ওই এসেছে আমার খান্ডারনী বউটা। ক'টা দিন যে একটু নিশ্চিন্তে কাটাব, তাও সহ্য হয় না। ঢুকতে দিবেন না স্যার।"
কিন্তু বিলাপধ্বনি ক্রমশ উচ্চগ্রামে চড়ছে। অগত্যা উঠতেই হল। বাইরে গিয়ে পিলে চমকানো এক ধমক দিতেই, সটান পায়ে পড়ে গেল সে! বড়ো টিফিনকৌটো ভর্তি মাছের চচ্চড়ি, এগিয়ে দিয়ে বললে,
"ও বড্ডো ভালোবাসে কিনা, ওরে না দিয়া খাই ক্যামনে..?"
"এখানে এসব নিয়ম নেই।"
"নিয়ম তো আপনার হাতে, আপনিই তো থানার 'মাঈ -বাপ্'।"
বোঝো কান্ড! ততক্ষণে কৌটোর ঢাকনা খুলে গেছে,পেঁয়াজ রসুনের গন্ধে থানা ম- ম। সেপাইগুলোর লোলুপ দৃষ্টি সেদিকে। তা বৌটার দিল্ আছে! সক্কলের জন্যই বেশ পরিমাণ মতো এনেছে, দারোগা বাবুর জন্য 'ইসপেশাল'।
যদিও নিয়ম নেই, তবুও লোভ সামলানো কঠিন, বিশেষ করে যার বাড়িতে রাঁধুনির জ্বর বলে দুপুরে ভাত জোটে না।
সিপাইরা কোত্থেকে যেন বড়ো এক ডেকচি ভাতও জোগাড় করে আনল। ব্যাস, জমে গেল ফিষ্টি। বউটা নিজে হাতে যত্ন করে, পরিবেশন করে খাওয়াল সব্বাইকে। সবাই মিলে এত গান্ডেপিন্ডে গিলল যে বেচারা চোরের ভাগ্যেই ঢুঁ ঢুঁ। মোটকথা পড়ে পাওয়া ফিষ্টিটা দিব্য জমে গেল। ভরপেট খেয়ে একটু বাদেই সেপাইরা ঢুলতে ঢুলতে থানার বারান্দাতেই লম্বা। বড়বাবুর মাথাও টেবিলে ঝুঁকে এল। ঘন্টা কতক বাদে, সবাই যখন চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম থেকে উঠল, ততক্ষণে চোর তার সংসার গুটিয়ে এলাকা ছেড়ে হাওয়া। গরাদের চাবি বড়বাবুর পকেটে।
কোমরের বেল্ট আর ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো নাক দিয়ে, বের হওয়া গরম ধোঁয়া, সামলাতে সামলাতে বড়োবাবু সার্চলাইটের আলোয়, সাইরেন বাজিয়ে রাতভর তল্লাশি চালালেন। হায়, ফল কিন্তু অষ্টরম্ভা!
তবে কিনা সব মন্দের তো ভালো দিকও আছে। গোলাপী ছাগলের চোর, ভয় পেয়ে চুপিচুপি ছাগল ফেরত দিয়ে গেল। কানাঘুষো শোনা যায় দারোগা বাবুর নাকি প্রমোশন হবে।
সবই ভালো হত, যদি রুলের গুঁতোয় পলাতক চোর আর তার বৌটাকে আচ্ছা করে...!
দিন কয়েক বাদে দারোগাবাবুর বাড়ির ঠিকানায় একটি পার্সেল এল। সঙ্গে ট্যারাব্যাঁকা অক্ষরে লেখা চিরকুট, 'জনৈক শুভার্থী'।
বাক্স খুলে পাওয়া গেল, ডজনখানেক নানা কায়দার বেশ পুরুষ্টু গোঁফ...
বাক্সের উপরে লেখা ―"ডিজাইনার ক্যাটাগরি।"
-সুমিতা দাশগুপ্ত