Image-Description
Stories
আরাধনা
Feb 12 2024 Posted by : montajpublishing

ইংরেজি নতুন বছরটার দেখতে দেখতে একমাসের ওপর বয়স হয়ে গেল। ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়। কনকনে শীতের দিন শেষ হয়ে এখন বেশ আরামদায়ক পরিবেশ। সূয্যিমামা এখনও তেমন রেগে উঠে চারদিক প্রখর তাপে জ্বালিয়ে দিতে শুরু করেননি, তবে সকালবেলায় স্কুল যাওয়ার আগে স্নান সারতে গেলে এখনও বেশ শীত শীত করে তিতলির। এই সময়টা তিতলির খুব প্রিয়। সদ্য কলকাতা বইমেলা শেষ হয়েছে। গল্পের বই এর পোকা তিতলি বাবা মার সাথে গিয়ে পছন্দ মতো অনেক বই কিনে এনেছে। স্কুল থেকে ফিরে সেই বইগুলো পড়ছে মনের আনন্দে। এরমধ্যেই সরস্বতী পুজোর আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। 

মা তিতলির জন্য সুন্দর ছোট্ট বাসন্তী রঙের ছাপা শাড়ি কিনে এনেছে। ক্লাস থ্রি-র তিতলি কী আর মায়ের মত অত বড় শাড়ি পরতে পারে! তিতলিদের বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়। মা নিজেই পুজো করে। তিতলি আগেরদিন বাবার সাথে গিয়ে পছন্দ করে ঠাকুর কিনে আনে। তারপর বাবা আর তিতলি মিলে পুজোর জায়গাটা সুন্দর করে সাজায়। তিতলি কাগজের ওপর এঁকে ফেলে রাজহংস, দেবীর হাতের বীণা। বাবা সুন্দর করে সেগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে সাজিয়ে ফেলে সিংহাসনের আশপাশটা। বাবা বাজার থেকে নিয়ে আসে ফল, মিষ্টি, ফুল আর পুজোর নানা উপকরণ। এইদিন ফলের মধ্যে বাবা কুল আনবেই আনবে। সরস্বতী পুজোর আগে যে কুল খাওয়া বারণ। তিতলি কুল খেতে খুব ভালোবাসে। বাবা বাজার থেকে কুল আনলে তিতলি ভুল করে তুলে খেতে যায়। মা বলেন, "আর একটা দিন অপেক্ষা কর তিতলি সোনা, কাল পুজো হয়ে গেলেই তোমায় কুল দেব।"

পুজোর দিন মা খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে নেয়। তারপর পুজোর জোগাড় করে, ঠাকুরের জন্য ভোগ রান্না সেরে তিতলিকে ডাকে। তিতলির কিন্তু সেদিন অত সকালে স্নান করতে হলেও অন্যদিনের মত শীত করে না। মা তিতলিকে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয়। তিতলি একটু লিপস্টিক লাগানোর আবদার করে। মা বুঝিয়ে বলে, "সবকিছুর একটা বয়স আছে তিতলি। শিশুরা হল ভগবানের বাগানে ফুলের মতো, তারা এমনিই সুন্দর। তাদের সরলতাই তাদের সৌন্দর্য্য।"

এরপর মা কী সুন্দর করে পুজো করে। সহজ সরল পুজোপদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ঘরোয়া ভাবে দেবীর আরাধনা করে মা। তিতলির তখন তার মাকে কেমন যেন মা সরস্বতীর মতোই মনে হয়। মা-ও তো কত পড়াশোনা করেছে আর সুন্দর গানও গায়। এরপর তিতলি দুপুরবেলা মায়ের হাতের খিচুড়ি,বাঁধাকপির তরকারি আর কুলের চাটনি খুব তৃপ্তি করে খায়।

তবে তিতলির কিন্তু সরস্বতী পুজোর দিন পড়া বন্ধ থাকেনা। সকালে না হলেও সন্ধেবেলা পড়তে বসতে হয়। মা বলে, "সরস্বতী ঠাকুর তো বিদ্যার দেবী। তাই পড়াশোনা করেই তার সঠিকভাবে আরাধনা করা যায়।"

সবই ঠিক আছে। কিন্তু তিতলির মনে একটা দুঃখ থেকেই যায়। তিতলিদের স্কুলটা খ্রীষ্টান মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত। স্কুলের ভেতর সুন্দর চার্চ আছে। সেখানে মা মেরীর কোলে ছোট্ট যীশুর মূর্তি। বড়দিন খুব ভালো করে পালন করা হয় তিতলিদের স্কুলে। পুরো স্কুলবাড়িটা সেজে ওঠে। স্কুলের মধ্যে সাজিয়ে তোলা হয় সেই গোয়ালঘর যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন যীশু খ্রীষ্ট। তারা আর ঘন্টায় সেজে ওঠে চারপাশ। কিন্তু তিতলিদের স্কুলে সরস্বতী পুজো হয়না। তিতলির পাড়ার অন্য স্কুলে পড়া বন্ধুরা এইদিন বাড়ির পুজো সেরে তাড়াতাড়ি স্কুলে যায়। সেখানে সব বন্ধুরা মিলে একসাথে অঞ্জলি দেয়। কত বড় প্রতিমা এনে পুজো হয়। উঁচু ক্লাসের দিদিরা পুজোর দায়িত্বে থাকলেও তিতলির বয়সী ছাত্রীরাও ছোট খাটো কাজের দায়িত্ব পায়। দুপুরে সবাই একসাথে স্কুলে খাওয়াদাওয়া করে। সারাটা দিন বন্ধুদের সাথে কী মজাতেই না কাটে ওদের! তিতলি এই আনন্দের ভাগ পায়না। বিকেলে খেলার মাঠে যখন পাশের বাড়ির সুমি বা পাশের পাড়ার দীপা তাদের স্কুলের পুজোর গল্প করে তখন তিতলির বেশ একটু হিংসেই হয়।

তাই সরস্বতী পুজো এলে অনেকখানি আনন্দের সঙ্গে একটু মনখারাপও লাগে তিতলির। তিতলির ক্লাসের প্রিয় বন্ধুরা যেমন টিনা,এষা,পালক সবার মনেই এই দুঃখটা আছে। ওদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে তিতলি। পুজো তো সবার বাড়িতেই হয়। কিন্তু বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে পুজো উপভোগ করার মজাই আলাদা। পাশাপাশি আছে পুজোর নানা কাজের দায়িত্ব পাওয়া ― মানে অনেকটা বড় হয়ে যাওয়ার সুযোগ। কিন্তু দুঃখ করে কী আর হবে! তিতলিদের স্কুলটা তো খুব নাম করা ― পড়াশোনা,খেলাধুলো,গান বাজনা সবেতেই খুব নাম ডাক। এক সরস্বতী পুজো হয় না বলে তো আর এমন স্কুল ছাড়া যায় না!

তিতলি অনেকবার বলেছে মাকে এই দুঃখের কথা। টিনা, এষা, পালক,বর্ণালীরাও বাড়িতে তাদের দুঃখের কথা জানিয়েছে। ওদের সবার মায়েরাই মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিতে আর ফিরিয়ে আনতে যায়। বাড়িও মোটামুটি কাছাকাছির মধ্যেই, তাই তিতলিদের মতোই ওদের মায়েদেরও খুব ভাব। কদিন ধরেই তিতলি দেখছে ওর মা আর বাকি চার বন্ধুর মায়েরা মিলে কিছু একটা পরিকল্পনা করছে। টিনা,পালকরাও বলেছে তাদেরও চোখে পড়েছে বিষয়টা। আগে মা কাকীমারা শুধু স্কুলেই এসে যা গল্প করত। এখন বাড়ি থেকেও ফোনে কথাবার্তা চলে। আর তিতলিরা কেউ ঘরে ঢুকলেই ফোন রেখে দেয়। কী এমন গভীর আলোচনা চলছে কে জানে! সত্যি বড়োদের মতিগতি বোঝা ভার!

এদিকে সরস্বতী পুজো এসে পড়েছে। তিতলি নিয়মমতো বাবার সঙ্গে গিয়ে ঠাকুর কিনে আনা,পুজোর সাজসজ্জায় ব্যাস্ত। কিন্তু এবার মায়ের ব্যাস্ততা অন্যবারের থেকে বেশি ওদের বাড়ির সামনের বাগানের যে অংশটা আগাছায় ভরে ছিল সেটা মা লোক লাগিয়ে পরিষ্কার করিয়েছে। তিতলি জিজ্ঞস করেছিল ―"কী হবে মা এই জায়গাটায়?"

মা বলেছে ―"হলেই দেখতে পাবি।"

দেখতে দেখতে পুজোর সকাল এসে গেল। অন্যবারের মতই পুজো নিষ্ঠাভরে শেষ হল। তিতলি জানলায় বসে দেখছিল সুমি শাড়ি পরে স্কুলে যাচ্ছে। তিতলির মনটা একটু খারাপ লাগছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল কারা যেন আসছে ওদের বাড়ির দিকে। খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু দূর থেকে বুঝতে পারছে না। কাছে আসতে তিতলি দেখল টিনা,এষা,পালক,বর্ণালী আর সঙ্গে ওদের মায়েরা! কী ব্যাপার! তবে কি মা আজ সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে ওদের বাড়িতে? যাতে তিতলি বন্ধুদের সাথে পুজোয় মজা করতে পারে। 

টিনা, এষাদের পেছন পেছনই এসে গেল সবিতা পিসি। সবিতা পিসি তিতলির মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করে। একটু দূরে সবিতা পিসির বাড়ি। তিতলি মার সঙ্গে গেছিল একবার। গলিটা খুব সরু আর খুব ছোট ছোট সব ঘর। সবিতা পিসির সাথে এসেছে পিসির ছোট্ট ছেলেটা যে তিতলির থেকেও ছোট। আর এসেছে আরো তিনজন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। তিতলি তো কিছুই বুঝছেনা, কী হচ্ছে কে জানে! এষা,বর্ণালীদেরও একই অবস্থা!

তিতলির মা বাগানের পরিষ্কার করা জায়গাটায় মাদুর পেতে সবাইকে বসতে দিল। তারপর তিতলিদের দিকে চেয়ে বলল ―"তোদের তো খুব ইচ্ছে বন্ধুদের সাথে মিলে সরস্বতী পুজো করার। মা সরস্বতী তো বিদ্যার দেবী, তাই পড়াশোনার, শিল্পকলার চর্চাই হল দেবীর আসল পুজো। নিজে জ্ঞান অর্জন করে আর অন্যের মধ্যে সেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিলেই দেবী সরস্বতী সন্তুষ্ট হবেন। সবিতা পিসি যাদের নিয়ে এসেছে ওরা সবাই প্রাথমিক স্কুলে ওয়ান, টু তে পড়ে। ওদের বাড়িতে কেউ পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার মতো নেই। এখন থেকে স্কুলে যাওয়ার আগে সকালে একঘন্টা তোমরা ওদের পড়া দেখিয়ে দেবে। এতে ওদেরও সুবিধে হবে আর তোমাদেরও পুরনো ক্লাসের পড়া ঝালিয়ে নেওয়া হব। |সবিতাপিসি রোজ ওদের নিয়ে আসবে। এখন থেকে শুধু নিজেদের রেজাল্টই নয়,ওদের রেজাল্ট ভালো করার দায়িত্বও তোমাদের। মনে রাখবে সরস্বতী পুজো একদিন। কিন্তু তোমাদের এই পুজো সারা বছরের। পুজোর মতোই নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব পালন করবে।

এই নতুন দায়িত্ব পেয়ে তিতলি আর ওর বন্ধুরা তো খুব খুশী। তিতলির মা আর বাকি কাকীমারা মিলে সবিতা পিসির সাথে আসা গণেশ, তিন্নি, মিলিদের নতুন খাতা,পেন কিনে দিল। দুপুরে সবাই মিলে খিচুড়ি,তরকারি খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরল।

দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেছে। তিতলিদের সকালের স্কুল কিন্তু একই ভাবে চলছে। তিতলিদের ব্যস্ততা বেড়েছে। স্কুলের পড়ার চাপ বেড়েছে। সকালে ঘুম থেকে একটু আগে উঠতে হয় গশেশ, তিন্নি, মিলিদের পড়া দেখিয়ে দিতে। কিন্তু তিতলি, এষা, বর্ণালীদের তার জন্য কোন দুঃখ নেই। ওরা পুজোর মতোই নিষ্ঠাভরে চালিয়ে যাচ্ছে ওদের কাজ। ছাত্রছাত্রীদের তরফেও উৎসাহের ঘাটতি নেই। আর তারই ফলস্বরূপ এবার তিতলিদের পাশাপাশি গণেশ, মিলিরাও খুব ভালো ফল করে ক্লাসে উঠেছে। তিতলিদের আর স্কুলে সরস্বতী পুজো হয়না বলে দুঃখ নেই। মা সরস্বতীর আরাধনা করার আসল পদ্ধতিটা ওরা শিখে গেছে।

-পৌলমী দাস


Popular Books


Comments

  • Ranu Sil

    কী অদ্ভুত সুন্দর একটি গল্প পড়লাম। খুব ভালো লাগল।

    Feb 12 2024
  • QCKBDTEuHU

    DgYrovUuLjesmp

    Mar 14 2024
  • QCKBDTEuHU

    DgYrovUuLjesmp

    Mar 14 2024
  • QCKBDTEuHU

    DgYrovUuLjesmp

    Mar 14 2024

Write a Comment