Image-Description
Stories
হরিৎ
Sep 6 2023 Posted by : montajpublishing


ঋতমদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে এসেছে। এই ছেলেটা মানে সৌম্য একটু অন্যরকম। নতুন ছেলে কোথায় ওদের সাথে নিজে থেকে এগিয়ে এসে বন্ধুত্ব করবে, তা নয়, সৌম্য যেন নিজের মনে আছে। একটু আনমনা টাইপ। কেউ সৌম্যর  সাথে কথা বললে ও বলে। কিন্তু নিজে থেকে এগোয় না। খেলতে ডাকলে খেলে কিন্তু নিজে থেকে খেলতে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে না। নতুন ছেলের এত গুমোর ওদের ভালো লাগছে না।   
      সৌম্য এমনিতে কথা বলে হাসিমুখে। ওর এই ব্যাপারটা প্রথমে সবার ভালো লেগেছিল, কিন্তু এখন বেশ বিরক্তি লাগে। হ্যাহ্, সবসময় এত আনন্দ কিসের রে? দেখছিস, ক্লাসের অন্য ছেলেরা তোকে কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না। তাও সবসময় থার্টি টু অল আউট করে রাখতে হবে!
      সৌম্যর মা অ্যানুয়াল স্পোর্টসের দিন এসেছিলেন, বন্ধুদের অনেকবার ওর বাড়ি যেতে বলেছেন। কিন্তু ক্লাসের ফার্স্ট বয় অর্চিষ্মান বলেছে, 'কেউ যাবি না। ও নিজে বলুক। দেখি ও কতদিন অহংকার নিয়ে থাকতে পারে।'   
      যুধাজিৎ সৌম্যকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, 'হ্যাঁরে তোর তো কোনো বন্ধু নেই। খারাপ লাগে না?' সৌম্য হেসেই উত্তর দিয়েছে, 'আছে তো। খুব প্রিয় বন্ধু। যুধাজিৎ জিজ্ঞেস করেছিল, 'কোথায়? এই স্কুলেই?' সৌম্য বলেছিল, 'না বাড়িতে।' আমার সাথে থাকে। যুধাজিৎ জিজ্ঞেস করেছিল, 'কে রে, তোর ভাই বা দাদা কেউ?' সৌম্য আবার হেসে উত্তর দিয়েছিল, 'না রে শুধুই বন্ধু। ওর নাম হরিৎ। ও খুব ভালো। হেল্পফুল।' যুধাজিৎ প্রশ্ন করেছিল, 'তোর বাড়িতে থাকে কেন রে? ওর বাবা মা নেই?' সৌম্য একটু ভেবে বলেছিল, 'আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কোথায় আছে আমরা কেউ জানি না।'
      যুধাজিৎ যখন অন্যদের এসে এই কথোপকথনটা বলল, সবাই বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল। অর্চিষ্মান বলেছিল, 'ও। এই জন্য ওর আর কোনো বন্ধুর দরকার নেই।' ঋতম বলল, 'এত প্রিয় কে বন্ধু বল তো? কোন স্কুলে পড়ে?' ঋতম কৌতুহল চাপতে পারেনি। এই কথাটাই জিজ্ঞেস করেছিল সৌম্যকে? ও বলেছিল, 'স্কুলে যায়না। আমার সাথে পড়ে।' ঋজু জিজ্ঞেস করেছিল, 'তোর হরিৎ কত বড়?' সৌম্য একটু  ভেবে বলেছিল, 'ঠিক বয়সটা বলতে পারব না। তবে আমার থেকে ছোট।'   
     সৌম্যকে নিয়ে ওদের যতই রাগ থাকুক না কেন, হরিৎ-কে নিয়ে ওদের মধ্যে খুব সাড়া পড়ে গেল।  অর্চিষ্মান বলেছিল, 'বুঝেছি, আসলে হরিৎ ওদের বাড়ির সার্ভেন্ট। খুব বাজে ব্যাপার। চাইল্ড লেবার রাখা উচিৎ নয়।' যুধাজিৎ একটু উষ্মার সাথেই বলেছিল, 'তুই বেশি জানিস! হতেই পারে না। সৌম্য বলেছে, হরিৎ ওর বন্ধু। ও ওর বন্ধুকে দিয়ে কাজ করাবে কেন?'  
      ক্লাস ফাইভের দেবায়ন ওদের পাড়ায় থাকে। আর থাকেন বায়োলজিস্যার স্বরূপ বক্সী। কিন্তু স্বরূপস্যারকে বলার সাহস ওদের নেই। ক্লাস সিক্সের ছেলেরা দেবায়নকেই দায়িত্ব দিল হরিতকে একবার দেখে আসার জন্য। তাই দেবায়ন একদিন  মাঠে খেলে ফেরার সময় সৌম্যদের বাড়ি জল খেতে গিয়েছিল। সৌম্যর মা ওকে আদর করে ঘরে এনে বসিয়েছে। নারকেল নাড়ু আর সন্দেশ খেতে দিয়েছে। সৌম্য আর ওর মা অনেক গল্পও করেছে ওর সাথে। সৌম্যর বাবা নেই। বছর পাঁচেক আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু ওদের বাড়িতে দেবায়ন এই মা ছেলে ছাড়া তৃতীয় কাউকে দেখেনি। 
       অর্চিষ্মান লাফাচ্ছিল। দেখলি, 'তোরা তো ওর সব কথা মেনে নিয়ে বলে আছিস। ও গুলবাজ নাম্বার ওয়ান। আমরা পাত্তা দিইনি বলে, ও একটা কাল্পনিক বন্ধু বানিয়ে আমাদের শুনিয়েছে।' যুধাজিৎ বলল, 'দেবায়নের একদিন গিয়ে দেখাতে কিছু প্রমাণ হয়না। হয়ত সে সময় হরিৎ বাড়িতে ছিল না।' ঋতম বলল, 'ঠিক আছে, আমি আজই বাড়ি গিয়ে সৌম্যকে ফোন করব। হরিতের সাথে কথা বলতে চাইব দেখি ও কী  বলে? সবসময় নিশ্চয় হরিৎ অন্য কোথাও থাকবে না।' পরদিন সবাই যখন ঋতমকে জিজ্ঞেস করল, 'কি রে হরিতের সাথে কথা বলেছিলি?' ঋতম দুদিকে ঘাড় নাড়ল। বলল, সৌম্য বলেছে, হরিৎ কথা বলতে পারে না। 
      এবার অর্চি নিজেই জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল, তোর বন্ধু হরিৎ বোবা? তাহলে তোর বন্ধু হল কী করে? সৌম্য একটু হেসে উত্তর দিল, 'ওর অনুভূতি আছে। ও ফিল করতে পারে। বন্ধু হতে গেলে আর কিছু নয় ফিলিংসটাই জরুরী।'  
ঋতম, যুধাজিৎ ঋজুরা একদিন সৌম্যর বাড়ি যেতে চায়। অর্চিষ্মান তো ফুঁসছে। সৌম্যকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু কাকিমা বলার পর ওরা কেউ যায়নি বলে এখন যেতে লজ্জা পাচ্ছে।    
      সুযোগ একটা এসে গেল। সৌম্যর জন্মদিন। কাকিমা ওদের ফোন নম্বর যোগাড় করে ফোনে নেমন্তন্ন করেছেন। ওরা সবাই দলবেঁধে গেল। গিয়ে দেখে স্বরূপস্যারও নিমন্ত্রিত। কিন্তু হরিৎ কোথাও নেই। ওরা প্ল্যানমাফিক প্রথমে কিছু বলল না। খাওয়াদাওয়া, আনন্দ করল। তারপর অর্চিষ্মান নাটকীয়ভাবে প্রশ্ন করল, 'কী রে সৌম্য তোর হরিৎ কোথায়?' সৌম্য একটু থতমত খেয়ে গেল। সেই ফাঁকে অর্চিষ্মান স্যারকে বলতে লাগল, 'জানেন স্যার, এ বাড়িতে সৌম্যর নাকি এক হেল্পফুল-বন্ধু থাকে। যে কথা বলতে পারে না।  কিন্তু অনুভূতি আছে। আবার কেউ ওকে দেখেনি। আপনি তো স্যার এ পাড়ায় থাকেন। আপনি কি এ বাড়িতে আর কোনো ছেলেকে দেখেছেন?'        
     এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ে স্বরূপস্যার একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।  বললেন, 'আ-আমি? কই ন্-নাতো?'
     কাকিমা এবার হেসে ফেললেন, বললেন 'তোমরা দেখতে পাচ্ছ না? ঐ তো হরিৎ।' উনি আঙ্গুল দিয়ে ঘরের কোণে একটা ঢাউস টব দেখালেন। আশে পাশে অনেকগুলো ছোটগাছ আর অর্কিডের ধারে ঐ টবটাতে একটা ঝাঁকড়ামাথার ঝাউগাছ। ওরা হতভম্ব। কথা সরছে না। কাকিমা বললেন, 'তোমাদের বন্ধু তো একটু ইনট্রোভার্ট। কারো সাথে নিজে থেকে কথা বলতে পারে না। কিন্তু বন্ধু নেই বলে দুঃখ করত খুব। আমার গাছপালার শখ। তাই আমিই ওকে এই বন্ধু এনে দিয়েছিলাম। সৌম্য ওর সাথে গল্প করে। ওর পাশে বসে পড়াশুনো করে। নামটাও ও দিয়েছে। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড।' ঋতম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কীভাবে?'
     স্বরূপস্যার ততক্ষণে পরিস্থিতি বুঝে ধাতস্থ হয়েছেন। বললেন, 'তাই যদি হয় সৌম্য তো তোমাদের মিথ্যে বলেনি। ও সবুজ, তাই ওর নাম হরিৎ। গাছের চেয়ে উপকারীবন্ধু মানুষের কে আর আছে? ও কথা বলতে পারে না, কিন্তু অনুভূতি আছে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বোস প্রমাণ করেছেন। তোমরা ওঁনার লেখা ‘অব্যক্ত’ বইটা পড়লে বুঝতে পারবে। গাছেদের সুখ-দুঃখ, স্নেহ-ভালোবাসা স্বার্থপরতা সবরকম অনুভূতি থাকে। ওয়েল ডান সৌম্য। তোমার থেকে অনেককিছু শেখার আছে।'
     অর্চিষ্মান হঠাৎ ছুটে এসে সৌম্যকে জড়িয়ে ধরল। বলল, 'আমিও ওর থেকে একটা জিনিস শিখলাম স্যার। বন্ধুত্বের জন্য অনুভূতিটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী।'

- তনুশ্রী দাস


Popular Books


Comments

  • Payel Agarwal (Basu Mallick)

    Khub bhalo likhechis Tanusree ???? Keep going ☺️

    Sep 7 2023
  • Aditi Das

    Darun hoyeche. Khub bhalo laglo.

    Sep 7 2023
  • Susmita

    Khub valo laglo boudi

    Sep 8 2023

Write a Comment