Image-Description
Stories
ছাতা
Jul 19 2023 Posted by : montajpublishing


পা-এ-চলা পথে চিঙ্কুর বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে সময় লাগে বাইশ মিনিট। আসলে নাকি অতক্ষণের পথ নয়, বাবা বলেন, যেহেতু ও ছোট্ট, তাই ছোটো ছোটো পা অনেক বেশি বার ফেলতে হয় ওকে, তাই তো এতটা সময় লেগে যায়। সকাল সাতটায় ওর স্কুল শুরু, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হয় ঠিক ছ’টা পঁয়ত্রিশে। একটু দেরি হয়ে গেলেই প্রার্থনা শুরু হয়ে যাবে। আর প্রার্থনা শুরুর পরে স্কুলে যাওয়ার শাস্তি হল— রোল কলের সময় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, প্রেজেন্ট তার হবে, কিন্তু পাশে থাকবে একটা নোট, পরের দিন বাবা বা মা’র লেখা চিঠি আনতে হবে যে কেন দেরি হয়েছিল। চিঙ্কুর প্রায়ই তো দেরি হয়ে যায়, চিঠি লিখতে লিখতে সবাই বিরক্ত। আর একদিন দেরি হলে, আর একদিন যদি চিঠি লিখতে হয়, মা বলেছেন, তার আগে পিঠে আস্ত পাঁচ-ছয় খানা তাল পড়বে! তাল পড়ার মানে তো চিঙ্কু জানে, তাই ওইসব ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই, সময় থাকতে বেরিয়ে পড়াই ভালো। নাহয় একটু আগেই বেরোল সে, আগে বেরতে তো অসুবিধা নেই...শুধু মুশকিল একটাই…।
ছোটো ছোটো পা ব’লেই তো শুধু দেরি হয়ে যায় না, দেরির আরও একটা কারণ আছে। সক্কালবেলায় পথে কত লোক, কতজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে গল্প সে করে না, কিন্তু এ-কথা সে-কথা দু’-এক কথা তো বলতেই হয়। না, এই পথে মানুষ তেমন থাকে না, এত সকালে কেই-বা কোথায় যাবে, যাদের সঙ্গে দেখা হয় তারা সব বেশিরভাগই না-মানুষ। কয়েকজন গাছ আছে, তিনজন ছাগল, একজন আছে বাছুর আর পাখি আছে বেশ কয়েকজন। এদের সবার সঙ্গে ওর অনেকদিনের চেনা-শোনা। এদের সব্বার নামও ও জানে। ওরাও জানে চিঙ্কুর নাম। নাম ধরেই তো ডাকে ওরা চিঙ্কুকে। অবশ্য যে-কেউ সেটা বুঝতে পারবে না।
তাহলেও কি মেকআপ দেওয়া যায় না? যেত… এতদিন যেত, কিন্তু আজকাল নতুন একটা সমস্যা হয়েছে কী—সকালে ঘুম থেকে উঠতেই ইচ্ছা করে না। প্রায় প্রতিদিন ভোরের দিকে বৃষ্টি। আধো-ঘুমে বৃষ্টির একটানা ঝমঝম কানে এলে মনে হয় দিনটা ছুটির দিন। চিঙ্কু তখন অন্যদিকে ঘুরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই রোজ রোজ উঠতে দেরি, উঠতে দেরি হলেই বেরোতেও দেরি। এক-একদিন বাবা দিয়ে এসেছেন কিন্তু সেটা তো আর প্রতিদিন হতে পারে না, হেঁটে যাওয়াই নিয়ম, হাঁটলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
সেদিনও আবার দেরি হয়ে গেল। তাড়াহুড়োতে ছাতা নিতেই ভুলে গেল চিঙ্কু। যেই না সে মাঝ-রাস্তা পর্যন্ত এসেছে, অমনি আকাশ কালো ক’রে মেঘ এল, বেচারা সূর্যটা হারিয়েই গেল কোথায়! গাছে গাছে একটা শোঁ শোঁ শব্দ উঠল আর ঝমঝম ক’রে নেমে পড়ল বৃষ্টির দল জঙ্গলের মাথার উপরে। বই-খাতা ভিজে গেলে ভালোই হয় চিঙ্কুর। সেসব নিয়ে ও চিন্তা করে না। খাতাগুলো সব ক’টা ভিজে গেলে হোমওয়ার্ক দেখানোর ঝামেলাটা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় কিন্তু চিন্তাটা অন্য জায়গায়। আজ চিঙ্কুর সঙ্গে আছে একটা নতুন গল্পের বই। পিসির কাছ থেকে উপহার পাওয়া। সেটা ও নিয়ে যাচ্ছিল বন্ধুদের দেখাবে ব’লে। এখন তো সেটাও ভিজে যাবে! কী যে ক’রে চিঙ্কু! কোথায় যে দাঁড়ায়! একটা দোকানও তো খোলেনি!


অগত্যা আর কোনো উপায় দেখে না সে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতেই হবে মনে হচ্ছে। হঠাৎ শোনে কে যেন তার পায়ের কাছে এসে ‘ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ’ ‘ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ’ ক’রে ডাকছে। আরে! এ যে ঘ্যাঙ্গাড়ু! সেই কোলাব্যাঙটা! এ-বছর বর্ষার শুরু থেকেই চিঙ্কুদের বাড়িতেই থাকে। চিঙ্কুর সাথে তো ওর বেশ অনেকদিনের চেনাশোনা। ড্যাবা ড্যাবা চোখে তাকিয়ে থেকে চুপ ক’রে থেকে অনেক কিছু বলে ও, সবাই শুনতে পায় না, কারণ ওর সেসব কথা শুধু চিঙ্কুর সঙ্গেই। সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসে যেদিন-যেদিন খুব ঘুম পেয়ে যায়, ও এসে বলে—
“চলো চলো, আর পড়তে হবে না, বই-খাতা গুটিয়ে ফেলো দেখি বাপু! এই যে আমি তো কোনোদিনই পড়তে বসি না, কার কী ক্ষতি হয়েছে তাতে?”
চিঙ্কু তখন বাড়ির কাজ শেষ না ক’রেই খাবার ঘরে গিয়ে উঁকি দেয়।
ঘ্যাঙ্গাড়ু যে চিঙ্কুর স্কুল দেখতে চায়, তা তো চিঙ্কু বুঝেইছিল, কিন্তু ওকে স্কুল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া তো আর কম হাঙ্গামার ব্যাপার নয়, সেই বুঝে চুপচাপই ছিল। কিন্তু আজ ব্যাটা সুযোগ বুঝে নিজেই পিছু নিয়েছে! তা বেশ, কিন্তু এখন আগে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষে পেলে হয়। ‘ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ’ ‘ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ’ ক’রে সামনের একটা পা তুলে ঘ্যাঙ্গাড়ু একটা দিকে ইশারা করে—ওমা! বেশ সুন্দর একটা মাশরুমের বন তো! এতক্ষণ চোখেই পড়েনি চিঙ্কুর। ছোটো-বড়ো কত মাশরুম! কিন্তু মাশরুম তো ব্যাঙের ছাতা!
“ঘ্যাঙ্গাড়ু, তুমি যাও, ব্যাঙের ছাতার তলে দাঁড়াও গে যাও বাপু! আমার এখন ভেজা ছাড়া আর উপায় কী!”
“উফফ, কথা শোনে না! ‘ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ'!”
ঘ্যাঙ্গাড়ু এবার দুই পা তুলে এমন একটা ইশারা করে যে চিঙ্কু স্পষ্ট বুঝতে পেরে যায় ও কী বলতে চাইছে। ও বলছে—
“চলো, চলো, ওই তো আমাদের ছাতা, তুমিও চলো না, খামোখা ভিজবে কেন! বৃষ্টি ছাড়লে স্কুলে যাবে’খন।”
“ইস্! মহা বোকা তো তুই! ব্যাঙের ছাতায় যদি মানুষ ধরত, তাহলে তো হয়েই যেত!”
“ভারি তো আমার বড়ো মানুষ! হ্যাঁ, তা বয়সে তুমি আমার থেকে একটু বড়ো হতেই পারো কিন্তু ঘরে তো সবাই তোমায় ছোটোছেলেই বলে!” ঘ্যাঙ্গাড়ু বলে ওঠে গলা উঁচিয়ে।
চিঙ্কু ভাবল—আর কথা বাড়িয়ে লাভ কী! ব্যাঙের ছাতাও তো ছাতা! বৃষ্টিটা ওই জঙ্গলের দিক থেকে ঝেঁপে আসছে এইদিকে, আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে ভিজে একসা’ হব, তার চেয়ে বরং যাই।


গিয়ে তো চিঙ্কু এক্কেবারে অবাক! ওমা! এই যে মাশরুমগুলোকে সে এতদিন একজাতীয় ছত্রাক ব’লে জেনে এসেছিল, এরা তো ঠিক তেমন নিরীহ কোনো জীব নয়। সব ক’টা জীবন্ত! ধুর, কী বোকা না সে! জীব তো জীবন্তই হবে…না, কিন্তু সেটা কথা নয়। এদের যে চোখ আছে, মুখ আছে, ঠোঁট আছে! কথা বলছে এরা নিজেদের মধ্যে! কতরকম বকাবকি, ঝগড়াঝাটি, আবার ভাবের কথাও…চোখের কত আকার-প্রকার, মুখের কত ভাব-ভঙ্গি! নড়াচড়াও করছে! ঘ্যাঙ্গাড়ু যেন একটি মাননীয় অতিথি নিয়ে এসেছে সঙ্গে ক’রে…কী আহ্লাদ সেই নিয়ে! এক-একটা মাশরুম দেখতে দেখতে বেশ বড়ো হয়ে উঠল। চিঙ্কুর অত বড়ো শরীরটাও দিব্যি ঢেকে গেল সেই জ্যান্ত ছাতার তলায়।

তবে মাশরুমটা বড়ো হল, নাকি চিঙ্কু ছোটো হয়ে গেল, সেটা অবশ্য বলা মুশকিল।
চিঙ্কু দেখল মাশরুম শুধু ব্যাঙের ছাতা নয়, আরও কতরকমের পোকামাকড় আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। পাশে রয়েছে ছোটো-ছোটো ঢিবি, ঢিবির গায়ে গর্ত, গর্তে ঢুকে গেলেই চোখে পড়বে লম্বা সিঁড়ি, সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাও, পৌঁছে যাবে পোকাদের ঘরে। পোকারা এখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে আর পুকুর থেকে উঠে আসছে সোনাব্যাঙ, কোলাব্যাঙ, ব্যাঙেদের ছানাপোনা, আরও কত ব্যাঙ-ব্যাঙ্গাচির দল। সবাই একসাথে জড়ো হয়ে হাত ধরাধরি ক’রে শুরু করে দিল বর্ষার নাচ। চিঙ্কু ওদের সাথে যোগ দেবে কি দেবে না ভাবছে, এমন সময় কীসের যেন শব্দে কান-ঝালাপালা হয়ে উঠল তার। শব্দটা খুব চেনাচেনা। আরে, এ তো বাবার সাইকেলের বেল!


চোখ খুলে চিঙ্কু দেখে সে সাঁকোর ধারে কালভার্টে ঠেস দিয়ে আধ-শোওয়া হয়ে ঘুমোচ্ছিল। বাবা বাজার থেকে ফেরার পথে এসে দাঁড়িয়ে বেল দিচ্ছেন। বাবার ফেরার সময় হয়ে গেল! এই রে, যাঃ, আর তো স্কুলে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। ইস্! এখানে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে! ঘুম পুরো ক’রে না উঠলে তো এমনই হবে। যাক গে, কাল আবার চিঠি নিয়ে যাওয়া যাবে’খন। এখন সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে বাড়ি তো ফেরা যাক।
বাড়িতে ঢুকতে যাবে কি চিঙ্কু, মুখোমুখি ঘ্যাঙ্গাড়ুর সঙ্গে দেখা। খিড়কির দরজা দিয়ে সেও আসছে থপথপ পায়ে।
“কী রে ঘ্যাঙ্গাড়ু, তুই কোথায় গেছিলি?”
“বা রে! মনে নেই তোমার? এই যে একটু আগেই তোমায় ঘুরিয়ে আনলাম আমাদের ওয়াণ্ডার-ল্যাণ্ড থেকে!”
“ধূর…ওটা তো একটা স্বপ্ন!”
“এক্কেরে বুদ্ধি নেই তোমার, সাধেই কি ওইরকম রেজাল্ট হয়! স্বপ্ন যদি হবে, তোমার স্বপ্ন আমি জানব কী করে?”
সত্যি তো…ব্যাপারটা স্বপ্ন হলে ঘ্যাঙ্গাড়ুর জানার কথা নয়।


স্বপ্নের ব্যাপারটা ঘ্যাঙ্গাড়ু জানল কী ক’রে? এই কথাই চিঙ্কু সারা-দুপুর বসে বসে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। বাবার সঙ্গে যখন সে আসছিল রাস্তা দিয়ে, দেখেছিল পথ-ঘাট ভিজে কাদা হয়ে গেছে। সাঁকো থেকে বাড়ি পর্যন্ত সব জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে। বাবার সঙ্গে যদিও ছাতা ছিল তবু বাবাও ভিজেছিলেন বেশ খানিকটা। থলের সবজিগুলো হয়ে উঠেছিল শিশির-ভেজা ঘাস...গাছের পাতা থেকে টুপ-টুপ জল ঝরছিল তখনও…কিন্তু…
কিন্তু কই! চিঙ্কু তো ভেজেনি এক-ফোঁটাও! সারা বৃষ্টির সময়টা খোলা আকাশের নিচে শুয়ে ঘুমিয়েও! ঘুমিয়ে ছিল কি সত্যিই তবে? স্বপ্নই ছিল সবটা? যা-হোক, না-হোক, ব্যাগটা তো ভেজেনি, ব্যাগের ভিতরে ছিল নতুন গল্পের বইটা, সেটা একটুও ভেজেনি—সবচেয়ে খুশির কথা এটাই!
সাত-পাঁচ ভাবছে চিঙ্কু। ঘ্যাঙ্গাড়ু আবার এসে হাজির—
“এবার আমাকে নিয়ে যাবে তো তোমার স্কুলে?”
“হ্যাঁ রে, ঘ্যাঙ্গাড়ু, সে আর বলতে! যে উপকারটা আজ তুই আমার করেছিস!”
“না না, উপকার টুপকার কিছু না, আমি তোমায় ওয়াণ্ডার-ল্যাণ্ড ঘুরিয়েছি, তুমি আমায় স্কুলে ঘোরাবে।”
“বেশ, তাই হবে, এবার ওয়াণ্ডার-ল্যাণ্ডের কেসটা আমায় একটু বোঝা দেখি।”
“আরে ও কিছু না, কাল যাওয়ার সময় লক্ষ ক'রো ভালো ক'রে, ডান-হাতে দেখতে পাবে মাশরুমের বনটা। ওটা ওখানেই থাকে। আমাদের ছাতা, ছোটো-ছোটো প্রাণীদের ছাতা। তোমাকে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম, তার কারণ, মন থেকে তুমি আসলে কাউকেই ছোটো ভাবো না।

সাকিলা খাতুন


Popular Books


Comments

  • Mohan Mitra

    খুব সুন্দর গল্পটা।

    Jul 27 2023
  • Ana

    মিষ্টি গল্প

    Aug 20 2023

Write a Comment